ড. বি এম শহীদুল ইসলাম: মব জাস্টিস নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় রয়েছে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রশাসন। এ বিষয়ে আলোচনা করার আগে মব জাস্টিস সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। ইংরেজিতে গড়ন শব্দের অর্থ উচ্ছৃঙ্খল জনতা, দাঙ্গাহাঙ্গামাকারী জনতা, হুজুগে জনসাধারণ বা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ জনতা ইত্যাদি। মব জাস্টিস একটি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধও বটে।
কোথাও কোনো অঘটন ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার পর আইনি আদালতে সোপর্দ করে বিচার নিশ্চিত করাটাই হচ্ছে আইনগত বৈধতা। কিন্তু এর পরিবর্তে যদি বিশৃঙ্খলা ও হাঙ্গামা সৃষ্টি করে জনগণ নিজেদের হাতে বিচারকার্য তুলে নেয়, তাহলে তা আইনের পরিপন্থি। যেকোনো আইনের ক্ষেত্রেই মব জাস্টিস বৈধ নয়।
মব জাস্টিসের বিস্তারিত বিশ্লেষণ : একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, ‘মব’ একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ। যার অর্থ উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আর ‘জাস্টিস’ অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। তাহলে ‘মব জাস্টিস’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় উচ্ছৃঙ্খল জনতার গণবিচার। এটিকে Mobocracy, Canaille, Confluence ইত্যাদি বলা যেতে পারে। তবে Mobocracy বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। মূলত মব জাস্টিস বলতে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকেই বোঝানো হয়েছে। সাধারণত এর ফলে কোনো অপরাধীকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিচার না করে উত্তেজিত উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি দেওয়ার পথ বেছে নেয়। এ ধরনের অন্যায় পদ্ধতি বেছে নেওয়ার কারণে সমাজ এবং রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা, অনাচার ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ জন্য এটিকে ‘মব জাস্টিস’ বলা হয়। প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় আইন কোনো ক্ষেত্রেই মব জাস্টিস সমর্থনযোগ্য নয়। এসব ঘটনা এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তির সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, হানাহানি, চাঁদাবাজি ও উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে সংঘটিত হয়। এটি কোনো আইনসম্মত বিচার পদ্ধতি নয়। সমাজে উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা ও বিতশ্রদ্ধা বা অপরাধের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে মব জাস্টিসের মতো ঘটনা সংঘটিত হয়। এটি কখনোই আইনসংগত বিচার পদ্ধতি নয়। যে কারণে মব জাস্টিসকে ‘অনৈতিক বিচার পদ্ধতি’ও বলা হয়। আইনে এ ধরনের বিচারের কোনো ভিত্তি নেই। এটি অনেকটা ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। হঠাৎ উত্তেজনার পরিবেশ থেকে মব জাস্টিস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সাধারণত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণ, কারও ওপর হামলা, অপহরণ, হত্যার অভিযোগ ইত্যাদির কারণে জনসাধারণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনার উত্তেজনা থেকে বিশৃঙ্খলা এবং বিশৃঙ্খলার ধারাবাহিকতা থেকে ‘মব জাস্টিস’ সংঘটিত হয়। এ ছাড়া মানুষ কোনো কোনো সময় অন্যায়কে অন্যায়ের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিচারকে ব্যবহার করে। এটা ঘটে এমন কিছু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দ্বারা, যারা কোনো কারণে ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং যাদের পক্ষে ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। অথবা যারা প্রচলিত আইনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাদের মনে ক্ষোভ, অবিশ^াস এবং নৈতিকতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে নিজেদের আক্রোশ মেটানোর কাজে প্রবৃত্ত হয়। এভাবে কোনো একটি অভ্যুদয়ের দিগন্তে এসে সমাজে শুরু হয় মব জাস্টিস বা উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার কালচার। তখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে নৈরাজ্যবাদ। যে কারণে এটিকে আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ বিষয়টি সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা।