ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছে ডান ও বাম রাজনৈতিক দলগুলো। চলছে বিস্তর আলোচনা।
এসব আলোচনায় সরকারকে চাপে রাখতে দৃশ্যমান নানা পদক্ষেপ নিতে বিএনপিকে পরামর্শ দেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য সবাই উদগ্রীব। দেশের মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
গত ১৯ এপ্রিল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছয় দিন ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে এই ঐকমত্য পোষণ করে জোট ও দলগুলো। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এখন পর্যন্ত ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, লেবার পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম, ছয় দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, এনডিএম নেতারা বৈঠক করেন। সম্প্রতি একটি হোটেলে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন সিপিবি-বাসদসহ বাম দলগুলোর নেতারা।
সর্বশেষ গতকাল বাংলাদেশ জন অধিকার পার্টি ও বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের সঙ্গে বৈঠক শেষে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখন কারা গণতন্ত্র চায় আর কারা গণতন্ত্র চায় না, এ বিষয়গুলোতে জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিই আমরা। বাংলাদেশের মানুষ বোকা না। তারা তো সবকিছু ফলো করছে। তিনি বলেন, নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরিয়ে আনা। এটা একটা জনগণের মালিকানার বিষয়। আর সংস্কার হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের পরও আরও বহু সংস্কার হতে থাকবে। আগামী বছরগুলোতেও সংস্কার হতে থাকবে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বক্তব্যে বিএনপিসহ মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এই ধোঁয়াশা দূর করতে সরকারকে চাপে রাখতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক জোট ও দলকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করবে দলটি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের আলোচনা চলমান রয়েছে। সবার সঙ্গে আলোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর নেতারা বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়াও দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্য হয়েছেন তারা।
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ফ্যাসিবাদ সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থাকার চেষ্টা করেছিল। তারা জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা করে নাই। এখন যদি কেউ অন্য কোনো নামে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে তারাও ওই একই কাতারে পড়বেন।
অন্যদিকে গণফোরাম নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা তৈরি হয় না। এটা করতে হলে নির্বাচনকে সংযোগ সেতু ধরা হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেন। তাই দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজনে ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন হওয়া উচিত। এটাকে যত প্রলম্বিত করা হবে, দেশ তত বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।
বৈঠক সূত্রগুলো জানায়, বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা এই সরকারকে যেমন তাদের আন্দোলনের ফসল বলেছেন, তেমনি সরকারকে সঠিক পথে রাখার জন্যও নিজেদের দায়িত্বের কথা তুলে ধরেছেন। সে জন্য সরকারকে বেকায়দায় না ফেলতে আপাতত কোনো কর্মসূচিতে না গিয়ে তাদেরকে চাপে রাখার কথা তুলে ধরেছেন। মিত্র দলগুলোর নেতারাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করে রাজপথের কঠিন কর্মসূচিতে না গিয়ে প্রত্যেক দলের তরফ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালনের কথা জানান। এর মধ্যে রাষ্ট্র মেরামতে বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচি প্রচার-প্রচারণার মতো করে অন্যান্য দলও তাদের মতো কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এসব কর্মসূচিতে নির্বাচন, গণতন্ত্র আর জনপ্রতিনিধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জনসচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনার ছাড়াও টিভি টকশো, আলোচনায় এ বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের নেতারা জানান, এখনও তাদের মধ্যে নির্বাচন বানচালের শঙ্কা কাজ করছে। দেশি-বিদেশি অনেক চক্রান্তে আবার দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে বলেও শঙ্কা করছেন তারা। এতে দেশের গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়তে পারে, পতিত স্বৈরাচার আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। এমন অবস্থায় দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলে এসব আশঙ্কা অমূলক হয়ে পড়বে। সব ধরনের শঙ্কা যেমন কেটে যাবে, দেশও নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করবে। রাজনৈতিক দলগুলোও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে দিতে পারবে।
বিএনপি নেতারা জানান, দেশের একটি শক্তিশালী বলয় বিএনপিকে টার্গেট করে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করেছে। নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারলে তারা বিএনপির অগ্রগতিকে অনেকটা রোধ করতে পারবে বলে এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তবে সে সব আমলে না নিয়ে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অবিচল রয়েছে। দলটি মনে করছে- এখন রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার সেটা দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা যাবে, যদি সরকার আন্তরিকভাবে সেটার উদ্যোগ নেয়।
দলের এক স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, নির্বাচন নিয়ে সরকারের আন্তরিকতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তারা একেক সময় একেক কথা বলছেন। এতে শুধু জনমনে নয়, দেশের সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেও সংশয়, সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে কাটিয়ে ওঠার দায়িত্ব সরকারের। এখন সরকার কীভাবে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিসমূহকে আস্থায় আনবে, কীভাবে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেবে, তা তাদের পরিকল্পনায় থাকতে হবে।
ওই নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলের কাজ হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করছেন। এমনকি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও এ বিষয়ে মতৈক্য সৃষ্টি করতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আগামী রমজানের আগে নির্বাচনের যে কথা বলা হয়েছিল, সেটাকেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন তারা। তবে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে তারা কোনো যোগাযোগ করছেন না বা তাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করার পরিকল্পনাও আপাতত বিএনপির নেই। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে। আমরা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছি আমাদের শরিক ও মিত্র দলগুলোর সঙ্গে। সবার একটাই কথা, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির সরকার হওয়া জরুরি।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, শুরুতে এনসিপিকে তারা যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, আমলে নিয়েছিলেন, এখন আর সেই আবেদন নেই তাদের মধ্যে। ওই দলটি গঠনের পর থেকেই বিএনপিকে টার্গেট করে যেভাবে মিডিয়া ট্রায়েল শুরু করে, দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে যেভাবে আজেবাজে বক্তব্য রাখতে থাকে, তাতে গণ-অভ্যুত্থানের শরিক হিসেবে আগের সেই অবস্থান আর নেই। বর্তমানে ওই দলটি আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই। আবার দলটিকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বীও মনে করছেন না। সে জন্য আগামীর রাষ্ট্র বিনির্মাণে সকলকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেখানে এনসিপিকে বাদ দিয়েছে বিএনপি।