বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া পৃথিবীর দ্বিতীয় মহাপাপ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআনের অনেক জায়গায় প্রধান মহাপাপ শিরক থেকে সতর্ক করার পাশাপাশি বাবা-মায়ের প্রতিও ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআন ও হাদিসে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বসহ আলোচনা করা হয়েছে।
বাবা-মা হলেন সেই মহান ব্যক্তিত্ব, যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে সন্তান দুনিয়ায় আসার সুযোগ পায় এবং বেড়ে ওঠে। বাবা-মায়ের অবাধ্যতা ইসলামে অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচিত, যা দুনিয়া ও আখিরাতে মারাত্মক পরিণতির কারণ হতে পারে। কোরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে কঠোর সতর্কবার্তা প্রদান করা হয়েছে। কোরআনে আল্লাহ বারবার বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
কোরআনে বাবা-মায়ের মর্যাদা
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কোরো না এবং বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার কোরো। তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাদের প্রতি “উফ” শব্দটিও উচ্চারণ কোরো না এবং তাদের ধমক দিও না। বরং তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা শুধু বড় গুনাহই নয়, বরং ছোটখাটো অবজ্ঞাও ইসলামে নিষিদ্ধ। তার মানে, বাবা-মায়ের প্রতি আমরা কখনোই চোখ রাঙিয়ে তো দূরের কথা উচ্চ আওয়াজেও কিছু বলতে পারব না। এই অধিকার আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেননি। কারণ পৃথিবীতে আমাদের কাছ থেকে বাবা-মা উত্তম আচরণ পাওয়ার জন্য অধিক হকদার।
হাদিসে বাবা-মায়ের মর্যাদা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাবা-মায়ের অবাধ্য, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ২৫৫১) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ কিয়ামতের দিন দয়া করবেন না—১. যে ব্যক্তি বাবা-মায়ের অবাধ্য; ২. যে ব্যক্তি নারীর বেশ ধারণ করে এবং ৩. যে ব্যক্তি অহংকারী ও আত্মম্ভরি।’ (নাসাঈ : ২৫৬২)
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাবা-মায়ের অবাধ্যতা দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির কারণ হতে পারে।
বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তানের দুনিয়ার পরিণতি
বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তানদের দুনিয়াতে যা পরিণতি হতে পারে, তাও ভয়ঙ্কর। যথা-
১. বরকতহীন জীবন : বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তানদের জীবন থেকে আল্লাহ বরকত উঠিয়ে নেন। তারা প্রচুর সম্পদ, খ্যাতি বা ক্ষমতা পেলেও শান্তি ও সুখ খুঁজে পায় না। এমন সন্তানদের দুনিয়ার জীবনেই বিপর্যয় নেমে আসে। হ্যাঁ, আমরা হয়তো বরকত বলতে শুধু টাকা-পয়সা, জমিজমা, ধনসম্পদ বুঝে থাকি, কিন্তু আমাদের দেশেই বহু মানুষ আছে যাদের কোটি কোটি টাকা আছে, কিন্তু সুখ-শান্তি নামক শব্দটা নেই। সুখ-শান্তি আর অঢেল ধনসম্পদ দুটো ভিন্ন জিনিস। আজ হয়তো আমি শিখরে উঠে ভাবতেই পারি, আমার শিখরে ওঠাতে কারো ভূমিকা নেই, কিন্তু সেই শিখর থেকে শিকরে নামাতে আল্লাহর এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। তাই বরকতময় জীবনলাভের অন্যতম শর্ত হলো জীবদ্দশায় বাবা-মাকে পেলে তাদের উত্তম সদাচরণ উপহার দেওয়া।
২. সমাজে অসম্মান : যে সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, সমাজও তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। সে তার আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে।
৩. নিজের সন্তানদের কাছ থেকে একই আচরণ প্রাপ্তি : একটি সুপরিচিত কথা আছে, ‘যেমন কর্ম, তেমন ফল।’ যে সন্তান তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, ভবিষ্যতে তার সন্তানও তার সঙ্গে একই আচরণ করবে। এটি দুনিয়ার মধ্যেই এটি আল্লাহর একটি গোপন শাস্তি।
৪. দুঃখ-কষ্টে জীবন অতিবাহিত করা : অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, সে জীবনে নানা সংকট ও বিপদের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা তার জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেন, যা তাকে কষ্ট ও অনুশোচনার মধ্যে ফেলে দেয়।
আখিরাতে বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তানের পরিণতি
১. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করা ও বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া।’ (বুখারি, ২৬৫৪) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ কেয়ামতের দিন করুণাময় দৃষ্টি দেবেন না—বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান, মদ্যপানকারী ও অহংকারী।’ (নাসাঈ : ২৫৬২)
এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, যারা বাবা-মায়ের অবাধ্য, তারা আখিরাতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।
২. জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়া : যে সন্তান তার বাবা-মায়ের অবাধ্য, সে জান্নাতের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাবা-মায়ের অবাধ্য, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ২৫৫১)
কীভাবে বাবা-মায়ের অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা যায়?
১. বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া : তাদের সঙ্গে নম্র ও বিনয়ী আচরণ করা এবং কখনো রূঢ়ভাবে কথা না বলা।
২. তাদের প্রয়োজন পূরণ করা : বাবা-মা বৃদ্ধ হলে তাদের সেবা-শুশ্রূষা করা এবং তাদের আর্থিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করা।
৩. তাদের জন্য দোয়া করা : বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা এবং তাদের জন্য কল্যাণ কামনা করা উচিত। কোরআনে এসেছে, ‘হে আমার রব! আপনি তাদের প্রতি দয়া করুন, যেমন শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা ইসরাঈল : ২৪)
৪. তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা : তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু না করা এবং সবসময় তাদের খুশি রাখার চেষ্টা করা।