অন্তর্জাতিক ডেস্ক: কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন পর্যটককে হত্যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করছে ভারত। এদিকে রাস্তায় ভারতীয়দের ক্ষোভের মুখে পড়ছেন কাশ্মীরিরা। ভুক্তভোগী অনেকের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এমনটি জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
সংবাদমাধ্যমটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সরকারি বাহিনী যখন কাশ্মীরের ঘন জঙ্গল ও পার্বত্য এলাকায় হামলাকারীদের খোঁজে অভিযান অব্যাহত রেখেছে, তখন ভারতজুড়ে বসবাসরত কাশ্মীরিরা, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা উগ্র ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী এমনকি তাদের সহপাঠীদের কাছ থেকে হেনস্থা, হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন।
পাঞ্জাবের শহর জলন্ধরে বসবাসরত আসিফ দার নামে এক কাশ্মীরি তরুণের আল জাজিরাকে বলেন, ‘সরু ও জনাকীর্ণ গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম— সবার চোখ আমার দিকে এবং তাদের দৃষ্টি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না।’
দার জলন্ধরের অ্যানাস্থেসিয়া এবং অপারেশন থিয়েটার টেকনোলজির দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। স্মৃতিচারণ করে দার বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল প্রত্যেকের চোখে প্রতিশোধের নেশা।’

আল জাজিরার খবরে বলা হয়, দার ও তার এক বন্ধু এটিএমে থামতেই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি তাদের কাছে এসে জাতিগত পরিচয় জানতে চায়। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। পরদিন ২৩ এপ্রিল সকালে দার দুধ কিনতে বাড়ি থেকে বের হন।
দার বলেন, তিনজন লোক আমাকে দেখে ইসলামবিদ্বেষী গালিগালাজ করে। তাদের একজন চিৎকার করে বলেন, ‘সে একজন কাশ্মীরি, সব কিছু তাদের কারণে হয়’।
এর আগে গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীরা পর্যটকদের ওপর গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে।
আল জাজিরা জানিয়েছে, ভারতের উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাড়িওয়ালারা কাশ্মীরি ভাড়াটেদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন; আর দোকানদাররা তাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে নারাজ। বাড়ি ফেরার চেষ্টা করতে করতে বেশ কয়েকজন কাশ্মীরি শিক্ষার্থী বিমানবন্দরে ঘুমোচ্ছেন।
দার বলেন, ‘প্রাণঘাতী এই হামলা চালিয়েছে অন্য কেউ। আর এর মূল্য পরিশোধের জন্য আমরা এখন এখানে রয়েছি।’ মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় ভারতের অভ্যন্তরে কাশ্মীরিরা ক্ষোভের শিকার হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আল জাজিরার সঙ্গে আলাপকালে প্রায় এক ডজন কাশ্মীরি জানান, তারা ভারতের অন্তত সাতটি শহরে নিজেদের কক্ষে আটকে রেখেছেন এবং অনলাইনে অর্ডার দেওয়া বা ক্যাব বুকিং করাসহ বাইরের কোনো যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন।
‘কাশ্মীরে কোনো সুযোগ নেই এবং আমি আমার ভবিষ্যতের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে চাই। এখানে ভালো করতে পারলে পরিবারকে সাপোর্ট দিতে পারব,’ বলেন আসিফ দার।
কিন্তু বাস্তবতা তার কাছে শোচনীয়। ‘এই কয়েক মাসে আমি যা শিখেছি তা ভুলে গেছি,’ তিনি বলেছিলেন। দার বলেন, ‘যেদিকেই তাকাই, সেখানেই অবিশ্বাস। আমরা অভিশপ্ত! কারণ আমাদের চেহারা এবং বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় দেয়।’
হামলার পরপরই বেঁচে যাওয়া একাধিক ব্যক্তির বিবরণ বেরিয়ে আসে, যা থেকে বোঝা যায় যে বন্দুকধারীরা আক্রমণকারী পর্যটকদের ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করেছিল। নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২৫ জনই হিন্দু পুরুষ।
তবে মঙ্গলবার থেকে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাশ্মীরবিরোধী এবং মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষের ঝড়ে নিহত ২৬তম ব্যক্তির পরিচয় আড়ালে পড়ে যায়। নিহত ওই ব্যক্তি একজন কাশ্মীরি মুসলিম, যিনি পর্যটকদের হত্যা থেকে আক্রমণকারীদের থামানোর চেষ্টা করেছিলেন।
‘আজকের ভারত জেনোফোবিক প্রচারে বেশি চলছে এবং এটি কয়েক বছর ধরে ছড়িয়ে পড়েছে; এর বেশিরভাগই মুসলিমদের বিরুদ্ধে,’ বলেছেন কাশ্মীরভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ শেখ শওকত।
জলন্ধর থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের রাজধানী দেরাদুনে উগ্র ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা ললিত শর্মা মঙ্গলবার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
হিন্দু রক্ষা দল নামে ওই সংঠনের নেতা ললিত শর্মা এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমরা সরকারের পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করব না … কাশ্মীরি মুসলিমরা, সকাল ১০টার মধ্যে চলে যান, অন্যথায় আপনাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’
মুস্তাক ওয়ানি নামে ২৯ বছর বয়সী এক কাশ্মীরি ছাত্রের সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডেও একই ধরনের সতর্কবার্তা আসতে শুরু করে।
গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা ওয়ানি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের জীবনটা এমনই।’ তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনা বারবার ঘটছে, ভারত কেন একবারে জঙ্গিদের শেষ করতে পারছে না? তাদের এত সৈন্য রয়েছে এবং জঙ্গিদের সংখ্যা এত কম … কেউ কাউকে খুন করলে আমাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়।’
হুমকির পর থেকে ওয়ানি অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর কাশ্মীর ফেরার ব্যবস্থা করেছেন। নিজের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, বন্ধুর বাড়িতে তালাবদ্ধ হয়ে বসে আছেন, আগামী সপ্তাহ থেকে টার্ম পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ‘আমরা ভয় পাই এবং নিরাপদ বোধ করি না। তবে আমি যদি আমার পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকি তবে আমার অনেক কিছু হারাতে হবে,’ তিনি বলেছিলেন।
তবে ওয়ানি বলেন, পুলিশ উগ্র ডানপন্থী নেতা শর্মাকে গ্রেপ্তার করার পরে তিনি কিছুটা স্বস্তি বোধ করেছিলেন এবং কাশ্মীরি শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে কর্তৃপক্ষ তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
আতঙ্কিত কাশ্মীরিদের ভিডিও এবং ভারতের বিভিন্ন শহরে তাদের শারীরিক নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসার পরে, জম্মু ও কাশ্মীরের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ অন্যান্য রাজ্য প্রধানদের কাশ্মীরিদের সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন।
আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ভারতের জনগণকে কাশ্মীরের জনগণকে তাদের শত্রু মনে না করার অনুরোধ করছি। যা ঘটেছে তা আমাদের সম্মতিতেই ঘটেনি। আমরা আমাদের শত্রু নই।’
২০১৯ সালে ভারত সরকার একতরফাভাবে জম্মু-কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সাবেক রাজ্যটিকে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। যদিও এক দশকের মধ্যে প্রথম রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের পরে গত বছর আবদুল্লাহ ক্ষমতায় এসেছিলেন। বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের ক্ষমতা অন্য যেকোনো প্রাদেশিক প্রশাসনের তুলনায় অনেক কম, যার বেশিরভাগ নয়াদিল্লির করায়ত্ত্বে।