কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ঐতিহাসিক কুতুবশাহী মসজিদ মুঘল আমলের স্থাপত্যশিল্পের অনবদ্য নিদর্শন। জেলা শহর থেকে ৪৫ কিমি পূর্ব-দক্ষিণে ভাটির রাণি অষ্টগ্রামে। চারদিকে নদ-নদী আর খাল-বিলঘেরা হাওর জনপদ। বর্ষাকালে সাময়িক দ্বীপাঞ্চলে রূপান্তরিত হওয়া এই উপজেলা সদরের প্রাচীন নিদর্শন অন্যতম স্মারক ঐতিহাসিক কুতুবশাহী মসজিদ। ৪০০ বছরের প্রাচীন এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদ এবং ইসলামসাধক অলি কুতুবশাহ্ ইয়ামিন (রহ.)-কে নিয়ে এলাকায় ধর্মীয় ভাব-আবেগের অনেক জনশ্রুতি রয়েছে।
মসজিদের পূর্ব-পশ্চিমে শায়িত শাহজালাল ইয়ামনি (রহ.)-এর সফরসঙ্গী শাহ কুতুব ইয়ামিন (রহ.)-এর নাম অনুসারে এ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে।
বাংলায় সুলতানি ও মুঘল আমলের কারুকার্যে বৈশিষ্ট্যে স্থাপিত পাঁচ গম্বুজের মসজিদের স্থাপত্যকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ এটিকে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে বলে দাবি করলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এই মসজিদ সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে। মসজিদের দেয়ালে স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যে প্রমাণিত হয়, এটি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সুলতানি ও মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর স্বাক্ষর বহন করছে।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে পুরাকীর্তি হিসেবে মসজিদটিকে ঘোষণা করে সরকার। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৪৬ ফুট ১১ ইঞ্চি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৭ ফুট ১১ ইঞ্চি। গ্রামীণ চৌচালা ঘরের চেয়েও এর কার্নিশগুলো অনেক বেশি বক্র। এর চার কোণে আট কোণের চারটি মিনার বা কর্নার টার্নেট আছে। বহিরগাত্রে রিলিংয়ের কারুকার্য রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে চারটিসহ সাতটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ বা দরজা রয়েছে। পূর্ব দেয়ালের প্রবেশপথের বিপরীতে পশ্চিম দেয়াল তিনটি মেহরাব ও ছাদ এবং বিশাল পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক ওই স্থাপনার চারপাশে বিশাল জায়গা নিয়ে সংরক্ষিত এলাকার প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই ডান পাশের বড় শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। মসজিদসংলগ্ন দক্ষিণের নামফলক ছাড়াও সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যের পাঁচটি কবর এখানে রয়েছে। পশ্চিম-উত্তরে কুতুবশাহ হাফিজিয়া মাদরাসা। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় ৩০ বছর সভাপতিত্ব করেছেন প্রখ্যাত আলেমেদীন সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহ.)-এর বংশীয় লেখক ও গবেষক মাওলানা সৈয়দ কুতুব উদ্দিন আহমেদ আল-হুসাইনী চিশতী (রহ.)। পূর্বদিকে উন্মুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেঘেরা প্রাঙ্গণ পেরিয়ে বিশাল পুকুরের পাকাঘাট।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই মসজিদে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভিড় করে। প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার পাশের জেলা ও উপজেলাগুলো থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হয় শাহ কুতুব (রহ.) উরস ও বড় শিন্নি উপলক্ষে।
এ ছাড়া প্রতিদিন শত শত মানুষ মসজিদ ও সুফি দরবেশের মাজার জিয়ারত করতে আসে বিভিন্ন এলাকার মানুষ। জনশ্রুতি রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ আত্মরক্ষার্থে মসজিদে আত্মগোপন করলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মসজিদটি ধ্বংসের চেষ্টা করে। তখন একাধিক সৈনিক রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়। তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানি বাহিনী মসজিদ এবং অষ্টগ্রাম ত্যাগ করে।
লোকমুখে শোনা যায়, ৯০ দশকে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার অষ্টগ্রামের আকাশসীমায় বিকল হয়ে অষ্টগ্রাম হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। পরে ঢাকা থেকে আরো দুটি হেলিকপ্টার এসে অষ্টগ্রামে বিকল হয়ে পড়ে। পরে, স্থানীয় নেতাদের পরামর্শে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শিন্নি মানত করেন ওই ওলির মাজারে। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব হেলিকপ্টার সচল হয়ে ওঠে।
অষ্টগ্রাম উপজেলার দেওঘর ইউনিয়নের মেনু মিয়া (৪৩) বলেন, ‘আমি ঢাকায় থাকি, যখনই বাড়ি আসি জুমার নামাজ আদায়ে কুতুব মসজিদ চলে আসি। এখানে নামাজ পড়তে মনে শান্তি আসে। এ ছাড়া অনেক ধর্মীয় ভাব-আবেগের কল্পকথা জড়িয়ে আছে মসজিদ ও মাজার নিয়ে।