মহসীন কবির: বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর দেওয়ার নীতিগত সম্মতি দেওয়া হয়েছে, এমন খবর প্রচারের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ বিতর্ক হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানাজন নানা মন্তব্য করেছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, রাখাইনে মানবিক সহায়তার চ্যানেল হবে। কিন্তু এটার ব্যাপারে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেসব শর্ত পালিত হলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব। তবে শর্তগুলো তিনি স্পষ্ট করেননি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, করিডোর নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। তবে জাতিসংঘ চাইলে ত্রাণ সরবরাহে লজিস্টিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের দিকে সরকার অগ্রসর হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেটহীন একটি অনির্বাচিত সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে সেটি বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। তাই এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক মতৈক্যে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, রাখাইনে মানবিক করিডোর দেয়া না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে, সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে।
জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান রাখাইনের মানবিক করিডোর দেয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডোরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তা বিষয় জড়িত থাকতে পারে।
জাতিসংঘের অনুরোধে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে রাখাইনে করিডোর দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মামুনুল হক।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে করিডোর হলে সেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এখন মিয়ানমার সরকার যদি দেখে এই করিডোরের ফলে আরাকান আর্মি লাভবান হচ্ছে। তখন তারা কি বসে থাকবে? তখনই সমস্যাটা তৈরি হবে। তখন এই করিডোরই আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগর এলাকা দিয়েও রাখাইনে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তা সামগ্রী পাঠানো সম্ভব। তাহলে কেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এই করিডোর দেওয়া হবে?
মিয়ানমারের সঙ্গে কোন পথে করিডোর হবে, সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। স্থল ও নৌ উভয় পথেই করিডোর হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এই পথেও করিডোর দিয়ে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো সম্ভব। তবে রাখাইনে কোন পথে মানবিক সহায়তা যাবে, সেটা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো আলোচনা হয়নি।
কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘রাখাইনে কথিত মানবিক করিডোর প্রদানের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং দেশকে আরেকটি প্রক্সি যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।’
শুক্রবার (২ মে) দুপুরে বগুড়া প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমার জিনিস থেকে কিংবা জাতিসংঘের সহায়তা আমি পৌঁছে দিচ্ছি কি না আরাকানে-আমি তো আরাকানের বর্ডার পর্যন্ত দিতেই পারি। আমার নিরাপত্তা বাহিনী আরাকানে ঢুকবে কি না, সেট স্পষ্টভাবে বলতে হবে। এখান থেকে জাতিসংঘ যদি যেতে চায় এবং আরাকান আর্মি যদি রাজি থাকে, এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ওই জাতিসংঘের কর্মীদের নিরাপত্তায় জাড়িত কি না, সেট নিয়েই জটিলতা।
সাদ রহমান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, এই মানবিক করিডোরের অর্থ প্রধানত আরাকান আর্মীকে ফুয়েল জোগানো। খাওনদাওন যা যাবে, তা রাখাইনের সাধারণ মানুষ পাবে এমন ভাবার কারণ নাই। আরাকান আর্মির যোদ্ধারা খাওয়ার পরে যেটা থাকবে সেইটা সাধারণকে দেওয়া হবে।
আমেরিকা চাইতেছে, রাখাইন রাজ্যের পূর্ণাঙ্গ কন্ট্রোল আরাকান আর্মির হাতে চইলা আসুক। ভারতও তাই চাইতেছে। রাখাইনের ভিতর দিয়া ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যাওয়ার একটা করিডোর করতে চায়। ফলে বাংলাদেশ যে এই মানবিক করিডোর দিতেছে, এবং মূলত আরাকান আর্মিকে শক্তিশালী করতেছে—এইটা আমেরিকার চাহিদা, তথাপি ভারতও এতে খুশি। কার্যত আমি এই মানবিক করিডোরে কোন সমস্যা দেখি না।
এস এম মোশি-উর রহমান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, আরাকান পাচ্ছে মানবিক করিডোর! এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম হুমকিতে পড়বে। মানবিকতা দেখাতে গিয়ে আমরা কোথায় গিয়ে দাড়াবো? এটি কি শেষ পর্যন্ত মানবিক করিডোর থাকবে, নাকি হয়ে উঠবে অস্ত্র পাঠানোর করিডোর! এগুলো বিশ্বের অন্য শক্তিধর রাষ্ট্র গুলো (বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, ভারত) ভালো ভাবে মেনে নিবে কি?
ড. ইউনূস তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য বাংলাদেশ কে বর্গা বা বিক্রি করে দিয়েছেন কি?
আরাকান আর্মি যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দশ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে যেদিন জলকেলি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল সেদিন বোঝা গিয়েছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আজ এই সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রেস ব্রিফিংয়ে সেই সত্যটা স্বীকার করে নিলেন। তাহলে ধরে নেওয়া যায় বিশ্ব মোড়লদের কথায় প্রক্সিযুদ্ধের দেশ হতে চলছে বাংলাদেশ।
মোজাম্মেল হক নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, পরাশক্তিদের কাছে পুরোপুরি ধরা দেওয়া খাল কেটে কুমির আনার মতো যেন না হয়, ব্যালেন্স করে এদের সাথে চলতে হবে। এতো অল্প সময়ে সকল উচ্চাকাঙ্খাকে একসাথে অর্জনের চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আন্তর্জাতিক ব্যবসা, বিনিয়োগ বাড়ানো আর নিরাপত্তা ইস্যু ভিন্ন বিষয়।