তাহমীদ: ১৮ জুলাই ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হযন শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন। ২০ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। তার চলে যাওয়ার প্রায় ৯ মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রিয় বোন শেখ মুমতাহিনা বিনতে মতিন এখনো খুঁজে বেড়ায় ভাইকে। প্রায়ই বাবার কাছে আবদার করে, ভাইকে নিয়ে আসার। শুধু সে নয় বাবা-মা-চাচারাও ভুলতে পারছেন না শাহরিয়ারকে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, শাহরিয়ারের ডাকনাম ছিল সুহার্তো বা রাজ। তার বাবা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন ও মা মমতাজ বেগম। যাদের প্রথম সন্তান ছিল সে। ২০২৪ সালে সে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি তার বিশেষ মনোযোগ ছিল না। তবে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় সে উদ্বুদ্ধ হয় এবং আন্দোলনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৮ জুলাই তার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেয় আন্দোলনে। সেদিন বিকালে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয় শাহরিয়ার। একটি গুলি তার ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মস্তিষ্ক ভেদ করে বের হয়ে যায়।
এ সময় শাহরিয়ারের বাবা ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। বিকালে খবর পান তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। খবর শোনার পর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে রাত ১টা বেজে যায়। অনেক বাধা পেরিয়ে তিনি ছেলের কাছে পৌঁছালেও তখন আর কিছুই করার ছিল না। শাহরিয়ার তখন লাইফ সাপোর্টে ছিল, ২০ জুলাই দুপুর ২টায় ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শাহরিয়ারের বাবা বলেন, অনেক ভোগান্তির পর ছেলের লাশ বুঝে পেয়েছি। এরপর রওনা হই ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের পথে। গাড়িতে বসে সন্তানের ঠান্ডা দেহটা ধরে রেখে একবারও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, ও আর কখনো ফিরে আসবে না। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ওর ছোটবেলার স্মৃতি, ওর হাসিমুখ। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। পরের দিন সকালে পারিবারিক কবরস্থানে আমার আদরের সন্তানকে দাফন করলাম। শেষবারের মতো ওর মুখ দেখলাম, মাটি চাপা দেওয়ার আগে ওর কপালে শেষবারের মতো হাত রাখলাম। আমার জীবন থেকে সব আলো নিভে গেল সেই মুহূর্তে। একবারের জন্যও ওর দিকে তাকিয়ে বলতে পারলাম না— বাবা, ভালো থেকো।
শাহরিয়ারের বাবা থেমে গেলেন। যেন আর কিছু বলার শক্তি নেই। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে এলো, বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
এ তরুণের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার মা মমতাজ বেগমও। তিনি বারবার বলছেন, আন্দোলন আমার বুকের ধন কেড়ে নিল।
শাহরিয়ারের ছোট বোন যার বয়স মাত্র আট বছর সেই শেখ মুমতাহিনা বিনতে মতিন তার ভাইকে এখনো খুঁজে বেড়ায়। সে বারবার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, আব্বু, ভাইয়া কোথায় গেছে? ভাইয়াকে নিয়ে আসো।
আবদুল মোতালেব শাহরিয়ারের চাচা। তিনি বলেন, আমরা বিচার চাই। বিচার একদিন পাব, এই আশায় বাকি জীবন কাটাব।
শহীদ শাহরিয়ারের স্বপ্ন ছিল বড় ব্যবসায়ী হওয়ার। বাবাকে কষ্ট করতে দেখে সে বলত, বাবা একদিন আমি বড় হব, তোমাকে আর কষ্ট করতে দেব না। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন কেবল পরিবারের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। তার বাবা বললেন, আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমি চাই, তার আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়। আমাদের দেশ যেন দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত হয়।