অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিএনপি। বুধবার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অংশ নিবে। সাক্ষাতে নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে জানতে চাইতে পারে বিএনপি, এমটাই জানা গেছে।
নির্বাচন নিয়ে যাতে বিভ্রান্তি দূর হয়, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানাবে বিএনপি। কেননা, সম্প্রতি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষে একেক সময় একেক বক্তব্য ও সময়সীমা ঘোষণায় সংশয় তৈরি হয়েছে বিএনপিসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে। যে কারণে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রূপরেখার বিষয়ে জানতে চাইবে বিএনপি।
অবশ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে জানিয়েছেন যে, দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার চাইলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে আর ছোট আকারের সংস্কার চাইলে নির্বাচন হতে পারে ডিসেম্বরে। কিন্তু ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন আয়োজনের বিরোধী বিএনপি। তারা চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়। বিএনপির এই দাবির পক্ষে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী চায় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন। অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবি—আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকার এবং সবশেষে জাতীয় নির্বাচন। মাঝেমধ্যে আগে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিও তুলছে এনসিপি। আবার এই সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার কথাও শোনা যাচ্ছে। ফলে দলগুলোর কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন না হলে আবারও আন্দোলনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়েই রাজনীতির মাঠে চলছে নানা আলোচনা। তবে সব জল্পনা-কল্পনা এবং নানা কৌতূহল আড়ালে রেখে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বিএনপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার অনুষ্ঠেয় বৈঠক প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গণমাধ্যমকে বলেছেন, ১৭ বছর ধরে আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। এ কারণেই তো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। এটি পুরোনো দাবি। এখনো সে দাবিতেই আছি এবং নতুন কোনো দাবি করিনি। আমরা ভেবেছিলাম, এই সরকার (অন্তর্বর্তী) আসার পরই স্বাভাবিকভাবেই তারা নির্বাচনের চিন্তা করবে। কারণ সারা বিশ্ব যেখানে গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে আছে সেখানে অগণতান্ত্রিক একটি দেশ টিকে থাকবে, এটা ঠিক না।
মির্জা আব্বাস বলেন, আওয়ামী লীগ ও হাসিনা গেছে; কিন্তু তার প্রেতাত্মা এখনো সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমনকি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কিংবা বিভিন্ন মিডিয়ায় জেঁকে বসে আছে। সেজন্য আমাদের সন্দেহ হয় যেখানে, প্রধান উপদেষ্টা বলেন ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা, আবার আরেকজন বলেন জুনে নির্বাচনের কথা, আবার আরেকজন বলেন ৫ বছর এই সরকার থাকার দরকার, জনগণ চায়। এই যে কথাগুলো—এতে একটা বিভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এতে তো জনগণের সন্দেহ রয়েই যায়। আমরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি। এটাকে পরিষ্কার করার জন্যই আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে যাব। সরকার নির্বাচনের নির্দিষ্ট রূপরেখা না দিলে বিএনপি কী করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আগে আলোচনাটা হোক। কী আলোচনা হয় দেখি, শুনি তারপর এ বিষয়ে কথা বলব।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শুরু থেকেই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল। তবে বিএনপি শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। বিএনপি বলছে, ডিসেম্বরের পর নির্বাচন নেওয়ার চেষ্টা হলে তারা বিরোধিতা করবে, প্রয়োজনে রাজপথে কর্মসূচি পালন করবে। তবে তার আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানাবে বিএনপি। এ বিষয়ে সরকারের মনোভাব বোঝার পর কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে দলটি। যদিও নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছে বিএনপি।
জানা যায়, সরকারের তরফে চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি ও তার মিত্রদলগুলো এতে অখুশি। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে তারা আবারও নতুনভাবে রাজপথে নামার কথা বলছে। নির্বাচন দ্রুত দেওয়ার ব্যাপারে তারা সরকারকে নানাভাবে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে। বিএনপির দাবি, তারা নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কাজ করবে। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সমমনা সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করবে বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পেলে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুযায়ী করণীয় ঠিক করে ইতিবাচক কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। এরই মধ্যে তারা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকও শুরু করেছে।
জানা গেছে, নির্বাচন ইস্যুতে নানা বিষয়ে এরই মধ্যে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা একাধিক বৈঠক করেছেন। গত সোমবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর পর বিএনপি জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান জানাবেন। সে লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চাওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা আগামী ১৬ এপ্রিল বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের সময় দিয়েছেন। সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী রোডম্যাপ চাওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টা জবাবে কী বলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপি ঠিক করবে নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিতে তারা সরকারের ওপর কীভাবে চাপ তৈরি করবে, কর্মসূচি কী হবে। এ বিষয়ে আজ সোমবারও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ১৬ তারিখের বৈঠকে কি হয় সেটি আগে দেখি, তার আগে কর্মসূচি নিয়ে কোনো মতামত দিতে চাই না। কারণ আন্দোলন-কর্মসূচি এগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এগুলো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আমরা আপাতত ১৬ তারিখের বৈঠক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির অনুষ্ঠেয় বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটা জানতে তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। প্রধান উপদেষ্টা বড় আর ছোট সংস্কার বলতে কী বোঝান সেটা পরিষ্কার করতে হবে। কারণ আমরা বলেছিলাম, নির্বাচনমুখী সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচন দিয়ে দিন। নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে বাধা কোথায়? কিন্তু এখন বড় সংস্কার বলতে উনি কী বোঝাচ্ছেন?