আজ পহেলা বৈশাখ; বাংলা ১৪৩২ সনের প্রথম দিন। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এবার আরও বর্ণিল আয়োজনে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতি। জাতীয় পর্যায়েও ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। ঐতিহ্য অনুযায়ী সকাল ৬টায় রমনা বটমূলে বর্ষবন্দনা শুরু করবে ছায়ানট। সকাল ৯টায় শুরু হবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রা। এবার এ শোভাযাত্রায় প্রাসঙ্গিক করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় এবং ফিলিস্তিনে বিরাজমান বর্বরতাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করেছে গান, নৃত্য, আবৃত্তি, ও নাটকের আসর। সারা দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে বসেছে বৈশাখী মেলা। গ্রামীণ খেলাধুলা, হস্তশিল্পের পসরা, পিঠাপুলি ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকানে জমে উঠেছে উৎসবের বাজার। সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতেও রয়েছে বিশেষ আয়োজন, জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। শেরাটন ঢাকাসহ রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোতেও থাকছে আবহমান বাংলা নিয়ে দারুণ সব আয়োজন।PauseMute
নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাদের বাণীতে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করা হয়েছে। দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি ডক্টর কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম (অব.), জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
এদিকে দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে। ঢাকা মহানগরসহ দেশের প্রধান শহরগুলোয় মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব সদস্য।
এবার পহেলা বৈশাখের আয়োজন দুই দিন, যার শুরুটা হয় গতকাল চৈত্রসংক্রান্তিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কনসার্টসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ১২টি জেলায় চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী সাধুমেলার আয়োজন শুরু হয়েছে গত শনিবার থেকে।
পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ ঢাবি চারুকলার বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় এবারের প্রতিপাদ্য ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এবারের শোভাযাত্রায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় প্রথমবারের মতো ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর ৪৯৪ জন শিল্পী বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়ে অংশগ্রহণ করবেন। এ ছাড়া যোগ দেবেন দ্ইু শতাধিক ব্যান্ড শিল্পী। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সম্মিলিতভাবে পরিবেশন করা হবে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’ গানটি। এ সময় গোটা পৃথিবীর শান্তিও কামনা করা হবে।
আজ সকাল ৯টায় শোভাযাত্রা শুরু হলেও সকাল ৮টা থেকে চলবে প্রস্তুতি। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে।
শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা শুধু নীলক্ষেত ও পলাশী মোড় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে আশপাশ দিয়ে শোভাযাত্রায় প্রবেশ করা যাবে না। শেষ প্রান্ত দিয়ে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে ঢাবি জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে। এ ছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার কথা বলা হয়েছে।
শোভাযাত্রায় অংশ নিতে নির্দেশনা : ঢাবি ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা এবং ব্যাগ বহন করা যাবে না। তবে চারুকলা অনুষদ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা চলাকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের জন্য ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখস্থ রাজু ভাস্কর্যের পেছনের গেট, চারুকলা অনুষদ সম্মুখস্থ ছবির হাটের গেট এবং বাংলা একাডেমির সম্মুখস্থ রমনা কালী মন্দির সংলগ্ন গেট বন্ধ থাকবে।
ক্যাম্পাসে নববর্ষের সব ধরনের অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে। ক্যাম্পাসে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রবেশ করা যাবে। নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের যানবাহন চালানো যাবে না এবং মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণ নিষেধ।
এ ছাড়া ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেল্প ডেস্ক, কন্ট্রোল রুম এবং অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প থাকবে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল মাঠ সংলগ্ন এলাকা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন এলাকা, দোয়েল চত্বরের আশপাশের এলাকা ও কার্জন হল এলাকায় মোবাইল পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া নববর্ষ উপলক্ষ্যে নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
থাকছে ড্রোন শো ও কনসার্ট
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আজ বিকাল ৩টায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়োজন করা হয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী ড্রোন শো ও কনসার্ট। আজ সোমবার বিকাল ৫টায় ড্রোন শো দেখানো হবে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত।
বাংলা একাডেমিতে সপ্তাহব্যাপী বৈশাখী মেলা
বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কর্তৃক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সপ্তাহব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
জাতীয় প্রেসক্লাব ও ডিআরইউর আয়োজন
জাতীয় প্রেসক্লাবে থাকছে বৈশাখী আয়োজন। সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার খই, মুড়ি, বাতাসা ও গুড়ের পায়েস ভোজন ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। অন্যদিকে সকাল থেকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ঐতিহ্যবাহী লোকগান ও লোকজ খাদ্য বিতরণ।
শেরাটনের বর্ষবরণে আবহমান বাংলা
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বর্ষবরণ মেলার আয়োজন করেছে শেরাটন, ঢাকা। আজ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হোটেলটির গ্র্যান্ড বলরুমে (লেভেল ১২) অনুষ্ঠিত হবে এ মেলা। এতে সংগীত ও ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনা, শিশুদের জন্য শিল্প প্রতিযোগিতা, নারীদের জন্য সংগীত চেয়ার, পুরুষদের জন্য রেড লাইট গ্রিন লাইট, মজার খেলা, সার্কাস ও পুতুল নাচ, ভবিষ্যদ্বাণী, বায়োস্কোপ ও খাবারের স্টল, ভিআর অভিজ্ঞতা, আর্কেড গেমস ও পিএসফাইভের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া শিশুদের জন্য থাকবে বিনামূল্যে ফেস পেন্টিং, ক্লাসিক ও আধুনিক স্টলে ভ্রমণ, বিনামূল্যে উপহারসহ নানা চমক। জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচে যে কেউ এই পুরো আয়োজন উপভোগ করতে পারবেন।
হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ
এবারও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চ্যানেল আই-সুরের ধারা হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ। তবে বিগত বছরগুলোর মতো নয়, এবার একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে বরণ করে নিতে ১৪ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠিত হবে এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান স্থলে থাকবে বিভিন্ন লোকজ মেলার স্টল।
ফিলিস্তিন বিপর্যয়ের কারণে বৈশাখ উদযাপনে যাবে না ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’
৪২ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শিশুপার্কের সামনে ‘নব আনন্দে জাগো’ শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠান করে আসছে ফকির আলমগীর ও তার দল ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। কিন্তু এবার ফিলিস্তিনে চলমান মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে এ অনুষ্ঠান হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
শাহবাগে থাকবে সাংস্কৃতিক ঐক্যফ্রন্ট
সাংস্কৃতিক ঐক্যফ্রন্ট বেলা ১১টা থেকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। ‘ওই নূতনের কেতন ওড়ে’ সেøাগানে বাংলা বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে। সেখানে থাকবে চিরায়ত বাংলা গান, দেশাত্ববোধক গান, জারি-সারি, পুঁথিপাঠ, গাম্ভিরা ও নাটিকা। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করবে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী, অনুপম সাংস্কৃতিক সংসদ, জাগরণ শিল্পীগোষ্ঠী, উচ্চারণ শিল্পীগোষ্ঠী, সন্দীপন সাংস্কৃতিক সংসদ, সওগাত সাংস্কৃতিক সংসদ, নিমন্ত্রণ সাংস্কৃতিক সংসদ, স্পন্দন সাংস্কৃতিক সংসদ, মহানগর ও রাজধানী শিল্পীগোষ্ঠী, মহানগর নাট্যসংসদ, রাজধানী থিয়েটার ও স্বপ্নবাড়ী সাংস্কৃতিক সংসদ।
উদীচী ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চৈত্রসংক্রান্তি
নববর্ষের একদিন আগে ‘ভুলে যাই দ্বন্দ্ব কেটে যাক ভ্রান্তি, শুভ-বার্তা আনুক চৈত্র সংক্রান্তি’- এই স্লোগানে চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গাব্দ ১৪৩১কে বিদায় জানিয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। বিকাল সাড়ে ৫টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশে সত্যেন সেন চত্বরে আয়োজিত হয় এই অনুষ্ঠানমালা। লোক গানের আসর, আবৃত্তি ও নাচসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দিয়ে সাজানো ছিল এই আয়োজন। অন্যদিকে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান।
বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় কার্যক্রম। ছিল শোভাযাত্রা, বাউল গান, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা ও র্যাফেল ড্র।