চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে ডিসেম্বরকে টার্গেট করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সেভাবেই সাজানো হচ্ছে নানান ছক। সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) একাধিকবার জানিয়েছে, সরকারের তরফে ঘোষণা এলে ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজনে তারা প্রস্তুত। রাজনৈতিক দলগুলো এর মধ্যেই নিজেদের যোগ্য প্রার্থী বাছাই, ভোটারদের কাছে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছে বিভিন্নভাবে। যেন নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলেই ভোটের মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় থাকতে পারে। এরই মধ্যে প্রায় প্রতিটি দলই তাদের সংসদীয় আসনের যোগ্য প্রার্থীদের সবুজ সংকেত দিয়ে রেখেছেন। একটি আসনে একাধিক প্রার্থীকে প্রস্তুত থাকার জন্যও নির্দেশনা রয়েছে কোনো কোনো দলের। যদি কোনো কারণে একজন প্রার্থী অযোগ্য বা বাতিল হন, তবে যেন বিকল্প প্রার্থী বাছাইয়ে কালবিলম্ব না হয়।
বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারাও ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন; ভেতরে ভেতরে চলছে নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি। সদ্য শেষ হওয়া ঈদুল ফিতরকে ঘিরে এনসিপির নেতারা ৪১টি সংসদীয় আসনে সক্রিয় থেকে মানুষের কাছে নিজেদের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন। অনেকে জুলাই শহীদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কেউ আবার আহদের পরিবারের পাশে থেকে প্রচারণা চালিয়েছেন। দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী সংগঠন হেফাজতে ইসলামও চাইছে দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচন আয়োজন করা হোক।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার বিএনপি। এমতাবস্থায় সরকারের দিক থেকে বলা হয়, ছোট সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে আর বেশি সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ নিয়ে বিএনপিসহ সমমনা
দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় আগামী ১৬ এপ্রিল নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট অবস্থান জানতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হবে। দলটির নেতারা বলছেন, স্পষ্ট বার্তা না পেলে নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে প্রয়োজনে রাজপথে নামবেন তারা। জানা গেছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তই হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিএনপির পক্ষ থেকে যত দ্রুত সম্ভব অবশ্য-প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে। এ নিয়ে দলটির শীর্ষপর্যায় থেকে সব স্তরের নেতাই সরব আছেন।
নির্বাচন ইস্যুতে দলের অবস্থান প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের তো আলাদা করে নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সব সময়ই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। এখন শুধু নির্বাচন প্রয়োজন। দেশের জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য মুখিয়ে আছেন। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে- এটা যেহেতু নিশ্চিত, সেহেতু বিএনপিকে ঠেকাতে ক্ষুদ্র একদল ষড়যন্ত্রকারী নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে দেশ সঠিক পথে থাকবে। কারণ দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি অবশ্যই এ দাবি জোরালো করবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের এজেন্ডার বিষয়ে ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। আমরা সে অনুযায়ী ওনাকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানাব। সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমাদের বৈঠকও হচ্ছে। সংস্কার প্রক্রিয়া চালু থাকা অবস্থায় নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া যাবে না, বিষয়টা তেমন নয়।
সম্প্রতি নির্বাচন ও জোট ইস্যুতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আমাদের সময়কে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সব মিত্রদের সঙ্গে জোট গঠনে জামায়াতে ইসলামী নীতিগতভাবে সম্মত। সেই লক্ষ্যে আলোচনা চলছে, বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে। আমরা একটা নির্বাচনী সমঝোতায় আশাবাদী, ইনশাআল্লাহ।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সব রকম প্রস্তুতিই চলছে জামায়াতের। এরই মধ্যে সব আসনের (তিনশ) সম্ভাব্য প্রার্থীও নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এ তালিকা চূড়ান্ত নয়। প্রয়োজন, পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রার্থী বদল হতেও পারে। যাই হোক, প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই মাঠে নেমে গেছেন।
এদিকে নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে হেফাজতে ইসলামও। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী আমাদের সময়কে বলেন, আমরা অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা নির্বাচন করব না। তবে দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে ভোট আমার অধিকার। আমরা দ্রুত নির্বাচন চাই। হেফাজতে ইসলাম মনে করে, দ্রুত নির্বাচন হলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল হবে।
এনসিপি নেতাদের কে কোন আসনে লড়তে পারেন :
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকা-১১ (রামপুরা-বনশ্রী) এলাকা থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নিজ আগ্রহের কথা জানিয়েছেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী উপজেলা নিয়ে গঠিত পঞ্চগড়-১ আসন থেকে প্রার্থী হতে চান। ঈদুল ফিতরে তিনি এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। এ ছাড়া দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ভোলা-১ আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন বলে জানা গেছে। তিনি ইতোমধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন নিজ এলাকা (রংপুর-৪ আসন) থেকে নির্বাচন করবেন বলে জনসংযোগ শুরু করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা-১৪ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব।
দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার নরসিংদী-২ আসনের বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করছেন। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আকরাম হুসেইন ঢাকা-১৩ আসনের (মোহাম্মদপুর-আদাবর) বিভিন্ন গলিতে নিজের পোস্টার সাঁটিয়ে প্রার্থী হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। আরেক যুগ্ম সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল আমিন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত ফতুল্লার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন ওয়ার্ডে জনসংযোগ করছেন। একইভাবে নিজ এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি চাঁদপুর-৫ আসন থেকে দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে পারেন বলে শোনা গেছে।
এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ (নোয়াখালী-৬), যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম (কুষ্টিয়া-১), যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক (চট্টগ্রাম-১৬), মশিউর রহমান (ঝালকাঠি-১), মো. নিজাম উদ্দিন (ঢাকা-৫), মাহিন সরকার (সিরাজগঞ্জ-৫), যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন (নওগাঁ-৫), মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন (পটুয়াখালী-২), আতিক মুজাহিদ (কুড়িগ্রাম-২), আশরাফ উদ্দীন মাহাদী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২) ও মাহবুব আলম (লক্ষ্মীপুর-১), যুগ্ম সদস্য সচিব এসএম সাইফ মোস্তাফিজ (সিরাজগঞ্জ-২), জয়নাল আবেদীন শিশির (কুমিল্লা-১০), যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মেজর (অব.) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (গাজীপুর-৩), মোল্যা রহমতুল্লাহ্ (বাগেরহাট-৩), যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত (ফেনী-২), দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক এসএম শাহরিয়ার (ঢাকা-৫), উত্তরাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিয়ন (নীলফামারী-৪), যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক গোলাম মর্তুজা সেলিম (ঠাকুরগাঁও-৩), আরিফুর রহমান তুহিন (ঝালকাঠি-১), সাকিল আহমাদ (মেহেরপুর-২), আশিকিন আলম (ময়মনসিংহ-৯), তুহিন মাহমুদ (নারায়ণগঞ্জ-৩), আবদুল্লাহ আল ফয়সাল (নরসিংদী-৫), খান মুহাম্মদ মুরসালীন (ঢাকা-৬), নাভিদ নওরোজ শাহ্ (কুমিল্লা-৬), উত্তরাঞ্চলের সংগঠক আবদুল্লাহ আল মনসুর (ফেনী-২) ও মিরাজ মেহরাব তালুকদার (ময়মনসিংহ-৫), আবদুল্লাহিল মামুন নিলয় (নরসিংদী-৩), মো. ইমরান হোসেন (ঢাকা-২), এহসানুল মাহবুব জোবায়ের (ফেনী-১), ফাহিম রহমান খান পাঠান (নেত্রকোনা-২), সোহেল রানা (মেহেরপুর-১) ও সাইয়েদ জামিলও (রাজবাড়ী-২) নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগ করছেন বলে জানা গেছে।