রংপুর জেলায় দুইবার, একবার করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নীলফামারী, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে গত সাত দিনে দেশে আটটি ভূমিকম্প হয়েছে। তবে হাল্কা শ্রেণির এসব ভূমিকম্প ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত বহন করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা ৫২ মিনিটে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের সূত্রও ভূমিকম্পের তথ্য নিশ্চিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকম্প সংঘটন বার্তায় বলা হয়, ৪.০ রিখটার স্কেল মাত্রার ভূমিকম্পটি হাল্কা শ্রেণির ভূমিকম্প।
বাংলাদেশ আর্থকোয়াক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০ এপ্রিল রাত ৩টা ২০ মিনিটে রিখটার স্কেল ২.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিল দেশের রংপুর জেলায়। এর আগে ৯ এপ্রিল রাত ১১টা ১৫ মিনিটে চট্টগ্রামে রিখটার স্কেলে ৪.২ মাত্রার; ৭ এপ্রিল রাত ৮টা ২৩ মিনিটে সিলেটে ২.৪ মাত্রার; ৬ এপ্রিল সকাল ৭টা ৪৬ মিনিটে ময়মনসিংহে ২.৫ মাত্রার এবং এদিন সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে সৈয়দপুরে ৩.২ মাত্রার; ৫ এপ্রিল ভোর ৫টা ৩ মিনিটে রংপুরে ২.৭ মাত্রার এবং আগের দিন ৪ এপ্রিল রাত ১১টা ২১ মিনিটে জামালপুরে ২.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
এ ধরনের হাল্কা ভূমিকম্পগুলো বড় ঝুঁকির বার্তা বহন করে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির (বিইএস) প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী।
গতকাল তিনি আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে সেটি কখন হবে কেউ বলতে পারবে না। ভূমিকম্পপরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় বলা না গেলেও বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেটি ৫ থেকে ১০ বছর কিংবা এর পরও হতে পারে। সে অনুযায়ী আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। সাধারণত একশ থেকে সোয়াশ বছর পরপর বড় ভূমিকম্প ঘটে। ১৮৬৯ সালে সিলেটের অদূরে কাছার এলাকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর পর ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে এবং ১৯২৩ সালে দুর্গাপুরে বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ফলে সেখানে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা সুপ্ত অবস্থায় আছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সেটিকে নাড়াচাড়া দিতে পারে। সম্প্রতি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি- মানে এই নয় যে, আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার কাছাকাছা সময় চলে এসেছে।
অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ বুয়েট ও জাপান ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন অ্যান্ড আরবান সেফটির (বুয়েট-জিআইডিপিএস)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি ভূমিকম্পে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে সারাবিশ্ব। সেই কম্পনে বাংলাদেশের মানুষও স্তম্ভিত, আতঙ্কিত। ছোট ছোট কম্পন দিচ্ছে বড় ভূমিকম্পের বার্তা। প্রতিবারই বিশ্বের কোথাও ভূমিকম্প হলে, শুরু হয় আলোচনা। রাজধানীসহ সারাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে কিছু দিন চলে কথাবার্তা। সপ্তাহ না ঘুরতেই থেমে যায় ভূমিকম্প নিয়ে তোড়জোড়।
ঢাকায় সমীক্ষা চালানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকায় ৬ লাখ ভবনের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, নতুন ভবনগুলোতেও উপেক্ষিত নীতিমালা। দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিল্ডিং কোড। শুধু ভূমিকম্প নিয়ে সরকারের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত বলে মনে করেন এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, ঢাকায় চার লাখ আবাসিক ভবন ও সাড়ে তিন হাজার কারখানা ভবন আছে। এর মধ্যে এক হাজার কারখানা ভবন এবং ২৫ শতাংশ আবাসিক ভবনের নির্মাণে ত্রুটি পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক হতাহতের পর দেশের ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের সতর্কবার্তায় মানুষের মনে নতুন করে উৎকণ্ঠা ভর করেছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও একই ধরনের বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁঁকির মুখে রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সতর্কবার্তায় আরও বলা হয়, ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে হবে। ঝুঁঁকিপূর্ণ ও পুরনো ভবনগুলোর সংস্কার করতে হবে। বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন ঠিকঠাক আছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসাপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নম্বরগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন কিংবা স্থাপনায় সংরক্ষণ করতে হবে। এগুলো দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখতে হবে। জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জাম, যেমন টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট, শুকনা খাবার, সুপেয় পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও শিশুযত্নের সামগ্রী বাসাবাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ওই বার্তায়।