মোতালেব জামালী: ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত ও অনেকে আহত হওয়ার পর চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটির সঙ্গে সাড়ে ছয় দশক ধরে কার্যকর সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করাসহ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত শিমলা চুক্তি বাতিল, ওয়াগা সীমান্ত বন্ধ ও ভারতীয় বিমানের পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করাসহ কয়েকটি পালটা পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে দুদেশের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে দুই দেশকেই ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি দুদেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি শান্তি চুক্তি ছিল। কিন্তু পহেলগাম হামলার পর সিন্ধু পানি চুক্তির পাশাপাশি এই চুক্তিটিও এখন হুমকির মুখে পড়ে গেল। নরেন্দ্র মোদি সরকারের আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত শুধু পানি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নয়, বরং পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির একটি উপায় হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারতের এই পদক্ষেপের পর পাকিস্তানের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিজস্ব পানি সংরক্ষণ কাঠামো শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতকে পালটা কঠোর কূটনৈতিক জবাব দেওয়া।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিন্ধু পানি চুক্তি ‘আপাতত অব্যবহৃত অবস্থায় থাকবে’। অর্থাৎ চুক্তির আওতায় থাকা বিভিন্ন সহযোগিতামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যেমন তথ্য আদান-প্রদান, যৌথ বৈঠক, প্রকল্পসংক্রান্ত নোটিস দেওয়া—সব বন্ধ থাকবে। ভারতের এই সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ভারত এককভাবে স্থগিত করতে পারবে না। সিন্ধু অববাহিকার নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য একটি জাতীয় ইস্যু, যা দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই সিন্ধুর পানি চুক্তি স্থগিত করলে বিষয়টিকে যুদ্ধের শামিল হিসেবে গণ্য করে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।
সিন্ধু অববাহিকায় দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত ছয়টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৬০ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। এটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর একটি। এই চুক্তির আওতায় সিন্ধু অববাহিকার পূর্ব দিকে অবস্থিত তিনটি নদী রাভি, বিয়াস ও সুতলেজের পানি ভারত ব্যবহার করবে। অন্যদিকে অববাহিকার পশ্চিম দিকে অবস্থিত তিনটি শাখা নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের পানির প্রবাহের ৮০ ভাগ পাকিস্তান ও ২০ ভাগ ভারত ব্যবহার করবে। সেভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। উল্লেখ্য, সিন্ধু নদ ও এর শাখা নদীগুলো এই অঞ্চলের কয়েক হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় ৭৭ বছর ধরে চলে আসা বৈরিতার সম্পর্কে রাজনীতি অত্যধিক গুরুত্ব পেলেও এবার ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নোংরা খেলা এবার পাকিস্তানের সঙ্গেও খেলতে শুরু করেছে ভারত। দেশটির এসব পদক্ষেপ পাকিস্তানের নদী, কৃষি ও জনজীবনের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং তা দেশটির অর্থনীতির জন্য ব্যাপকভাবে বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। কারণ সিন্ধুর পানি চুক্তি স্থগিত করার ফলে কেবল পানির প্রবাহই বন্ধ হবে না, পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
উজান থেকে নেমে আসা নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ একেবারে কমে গেলে তা পাকিস্তানের কৃষিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করবে। পাকিস্তানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেচভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা, যা সিন্ধু অববাহিকার তিনটি নদীর পানির স্বাভাবিক সরবরাহের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। ফলে চাষাবাদের সময় পানির প্রবাহে সামান্য পরিবর্তন হলে ফলন কমে যাবে এবং বিকল্প উপায়ে পানির ব্যবস্থা করতে গেলে তা একদিকে সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে এবং খরচও বেড়ে যাবে। এ ছাড়া পাকিস্তানের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎই সরবরাহ করা হয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো থেকে। ভারতের পদক্ষেপের কারণে নদীগুলোয় পানির প্রবাহ কমে গেলে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং সারাদেশে লোডশেডিং বাড়বে।
চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা হলো ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই পানি ব্যবহার করবে, কিন্তু কোনো দেশ কোনোভাবেই পানির প্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না। ভারত এই নদীগুলোকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ও সীমিত সেচ দিতে পারলেও পাকিস্তানের প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনভাবে প্রবাহ থামানো বা পানি জমা করতে পারবে না। এই বিধিনিষেধগুলো কারিগরি ও আইনি দিক থেকে সুনির্দিষ্ট করা রয়েছে চুক্তিতে।
চুক্তি অনুযায়ী, তথ্য বিনিময়, প্রকল্প পর্যালোচনা ও নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য স্থায়ী কমিশন রয়েছে। কোনো বিষয়ে বিরোধ হলে তা প্রথমে কমিশনে, তারপর নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে এবং সবশেষে যায় আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে যেখানে ভূমিকা রাখে বিশ্বব্যাংক। এই চুক্তির কোনো মেয়াদ নেই এবং কোনো পক্ষই একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না। তবে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তিতে পরিবর্তন আনা যাবে।
ভারত চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিলেও চুক্তির এই শর্ত অনুযায়ী এখনই পাকিস্তানে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না। বিশেষ করে আগামী মাস, অর্থাৎ মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পানির উচ্চ প্রবাহের মৌসুমে পানির প্রবাহ বন্ধ করা ভারতের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ এই পাঁচ মাস অনবরত বরফ গলতে থাকে। এতে নদীগুলোয় বিলিয়ন বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হতে থাকে। প্রবল এই প্রবাহ থামানোর মতো বিশাল কোনো বাঁধ বা অবকাঠামো ভারতের নেই। ছোটখাটো যেগুলো আছে, সেগুলোর পানি আটকানোর ক্ষমতা বা ধারণক্ষমতা খুবই কম। ফলে আগামী কয়েক মাসে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার ভারতের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের কোনো ক্ষতি হবে না।
তবে এই সময়ের পরে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির প্রবাহ যখন কমে যাবে, তখন ভারত নদীর পানিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে। ভবিষ্যতে ভারত পানি নিয়ে পাকিস্তানকে বেকায়দার ফেলার পরিকল্পনা করে যদি বড় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়, তা হলেও তাতে দীর্ঘ সময় ও অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। তবে পাকিস্তান ভারতকে অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সিন্ধু অববাহিকার পশ্চিমাঞ্চলের কোনো নদীতে বড় বাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিলে তা হবে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিন্ধু অববাহিকার পানি বিরোধ নিয়ে ১৯১৩ সালে সালিশি আদালতের একটি রায় পাকিস্তানের পক্ষে যায়। ওই রায়ে বলা হয়, ঝিলাম নদীর উজানে ভারতের কিসাগঙ্গা প্রকল্প দিয়ে ভাটির দিকের পানির প্রবাহ আটকে রাখা যাবে না। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক সুরক্ষার জন্য ন্যূনতম যে পানির প্রয়োজন হবে, পাকিস্তানের তা ভারতকে অবশ্যই ছাড়তে হবে। সিন্ধু পানি চুক্তির আলোকেই এই রায় দিয়েছিল আদালত। তবে এরপর ২০১৬ সালে উরিতে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সিন্ধু পানি চুক্তির আলোকে পাকিস্তানের সঙ্গে তথ্যবিনিময় স্থগিত করে। পরে অবশ্য তারা আবার বলে, পানি চুক্তি তারা মেনে চলবে। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে ভারত দুদেশের যৌথ সম্মতিতে পানি চুক্তিতে পরিবর্তন আনার ধারা ১২(৩) সংশোধন করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু পাকিস্তান আলোচনায় বসতে অস্বীকার করে। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে দুদেশই আইনি লড়াইয়ে নেমেছে। ফলে এবার ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে পাকিস্তানকে চাপে ফেলার যে কৌশল নিয়েছে, তাতে তারা শেষ পর্যন্ত কতটুকু সফল হবে, তা এখনই স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র : আল জাজিরা, ডন ও রয়টার্স