শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও নিম্ন আদালতে ৬০৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়া পর থেকে এসব মামলা দায়ের করা হয়। জুলাই ও আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন ৫০টি থানায়। শুধু একটি থানা যাত্রাবাড়ীতেই মামলা হয়েছে ১১২টি। এছাড়াও ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ধানমন্ডি, ওয়ারি, চকবাজার, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব ও শাহবাগ থানায় প্রায় ১৮৯টিরও বেশি মামলা দায়ের হয়েছে। ঢাকার ৫০টি থানায় তার নামে মোট মামলা হয়েছে ৩৮৮টি।
মামলাগুলোর এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলার ১ নম্বর আসামি পতিত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর মামলার আসামিদের সংখ্যায় স্থানীয় এমপি, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও কিছু পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম রয়েছে।
আবার কোনো কোনো মামলার এজাহারে হেলমেট বাহিনীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকাংশর মামলার বাদী হয়েছেন ভিকটিম। আবার কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে ঘটনা উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছেন। তবে যারা সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা দায়ের করেছেন সেসব বাদী ঘটনাস্থলে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছেন তার নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছেন। এসব মামলার তদন্তে লক্ষ করা গেছে ‘ধীরগতি’। ওইসব মামলা হওয়ার ৬ মাস পার হয়ে গেলেও এর তদন্তের জট খুলছে না। এজন্য, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৬৪টি জেলার এসপিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠিটিতে বলা হয়েছে, ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে যেসব মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলো দ্রুতই শেষ করতে বলা হয়েছে। ওই মামলার তদন্ত শেষ হলে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অবহিতকরণ এবং নির্দেশনা অনুযায়ী চার্জশিট দিতে বলা হয়েছে। যদি মামলার তদন্তে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে দেরি হয় তাহলে সেই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারদের অবহিতকরণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, শেখ হাসিনার নামে সর্বশেষ ঢাকার নিম্নআদালতে মামলা হয়েছে ২০ই মার্চ। সরকারি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ২০১ জনের বিরুদ্ধে নালিশি (সিআর) মামলার আবেদন করা হয়েছে। এছাড়াও ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার নামে দুটি মামলা চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আইজিপি বাহারুল আলম সোমবার রাতে আমার দেশকে জানান, ‘ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন থানায় শেখ হাসিনার নামে অসংখ্য মামলা হয়েছে। ওইসব মামলার অধিকাংশই এজাহারে তাকে সুপিয়র রেসপনসিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়) দেখানো হয়েছে। তিনি আরো জানান, আমরা তদন্ত করে দেখছি ওই ঘটনায় কে গুলি করে হত্যা করেছে। শিগগিরই মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করা হবে।
ডিএমপির ডেমরা জোনের এসি নাসির উদ্দিন জানান, প্রায় শতাধিক মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর প্রধান আসামি হচ্ছেন শেখ হাসিনা। এছাড়াও ওই সময়ের স্থানীয় এমপি, মন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ রয়েছে। মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। দ্রুতই সেগুলো শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।’
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই তার নামে মামলা দায়ের শুরু হয়। অধিকাংশই হত্যা মামলা। হত্যা মামলা ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুম, অপহরণ, হত্যাচেষ্টা, মানহানি ও তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সম্পদ দখলের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার থানাগুলোতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ঢাকার থানাগুলোতে ৩৮৮টি, ঢাকা মহানগর আদালতে ৫২টি মামলা দায়ের হয়েছে। ওইসব মামলায় প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। জানা গেছে, ঢাকায় যাত্রাবাড়ী থানায় ১১২টি, মোহাম্মদপুর থানায় ১৩টি, মিরপুর থানায় ১৬টি, ধানমন্ডি থানায় ৯টি, শাহবাগ থানায় ৮টি, ওয়ারি থানায় ৫টি, চকবাজার থানায় ৬টি, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১২টি ও উত্তরা পূর্ব থানায় ৮টি মামলা দায়েরের খবর পাওয়া গেছে।
পুলিশ জানায়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ঢাকা ছাড়াও দেশের জেলাগুলোতে শেখ হাসিনার নামে মামলা দায়েরের খবর পাওয়া গেছে। যেমনÑ চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটন পুলিশের থানাগুলোতে ২৪টি, রাজশাহীতে ১২টি, খুলনাতে ৯টি, ময়মনসিংহে ৮টি, রংপুরে ৭টি, সিলেটে ৫টি ও বরিশালে ৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। পুলিশ জানায়, শেখ হাসিনার নামে মানিকগঞ্জে ২টি, রাজবাড়ীতে ৩টি, ফরিদপুরে ২টি, নারায়ণগঞ্জে ৯টি, কুমিল্লায় ৫টি, ফেনীতে ৬টি, লক্ষ্মীপুরে ৫টি, নোয়াখালীতে ৪টি, ভোলাতে ৩টি, গাজীপুরে ৯টি, টাঙ্গাইলে ৪টি, সিরাজগঞ্জে ২টিসহ অন্যান্য জেলায় আরো ৪০টি মামলা দায়ের হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার থানাগুলোতে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ২৫টি, শেখ হাসিনার একমাত্র ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ১৯টি ও শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে ৯টি মামলার খবর পাওয়া গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মামলাগুলো দায়ের হয়েছিল। আন্দোলনে থানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ও পুলিশ সক্রিয় না থাকার কারণে তদন্ত প্রক্রিয়া ধীরগতি দেখা দিয়েছে। তবে মামলাগুলোর যাতে দ্রুতই তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করা হয় এজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে জেলার এসপিদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মামলাগুলো তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্ত করতে ভয় পাচ্ছিলেন। তাদের মনে ভীতি জেগেছিল যে, আবার যদি আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাক করে তাহলে তারা বিপদে পড়বে। তবে জেলার এসপিদের পক্ষ থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তারা অভয় দিয়েছেন যে, তাদের তদন্তের দায়িত্বের সব ভার তারা বহন করবেন।
পুলিশ জানায়, যাত্রাবাড়ী থানায় শেখ হাসিনার নামে বেশি মামলা হওয়ার কারণ হচ্ছে যে, যাত্রাবাড়ীর মোড়, কদমতলী, সাইনবোর্ড এলাকায় ব্যাপক হারে আন্দোলন গড়ে তোলে ছাত্র-জনতা। সেখানে পুলিশ একাধিকবার ক্রাকডাউন চালালেও ছাত্র-জনতাকে সেখান থেকে সরানো যায়নি। এতে ব্যাপকহারে ওই এলাকায় গুলিবর্ষণ করে। এতে শত শত আন্দোলনকারী নিহত হয়। বেশি নিহতের ঘটনায় ভিকটিমের পরিবার যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শেখ হাসিনাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশদাতা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এদিকে, গত ২০ সরকারি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদ হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ২০১ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার এজাহারে আসামিরা হচ্ছেন, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানা, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, সালমান এফ রহমান, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, মনিরুল ইসলাম, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, মসিউর রহমান, ড. গওহর রিজভী, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার, নাঈমুল ইসলাম খান, নঈম নিজাম, শ্যামল দত্ত, সুভাষ সিংহ রায়ের নাম রয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদী হয়ে মামলাটি করেন রাজু নামে এক ব্যক্তি।