মহসীন কবির: রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ চলছে। সংলাপে বিভিন্ন প্রস্তাব উথ্থাপন হয়েছে। কোনো প্রস্তাবেই শতভাগ একমত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো। শাতভাগ এক না হলে কি হবে এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত প্রথম ধাপের সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব সংবলিত স্প্রেডশিট দেওয়া হয়।
সেগুলোর ওপর লিখিত মতামত গ্রহণের পর এখন সরাসরি আলোচনা চলছে। প্রথম পর্বের বৈঠকে নিজেদের মতামত তুলে ধরছে রাজনৈতিক দলগুলো। এর মধ্যে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ১৭টি দলের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে একদিন বসলেও আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই দিন শেষ হয়।
সংলাপ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমেকে বলেছেন, অনেকের মতামত পাওয়া গেছে। সেগুলো পর্যালোচনা চলছে। তবে কিছু বিষয়ে প্রাথমিকভাবে একমত পোষণ করলেও সেটির বিস্তারিত পর্যালোচনায় গেলে ফের মতপার্থক্য দেখা দেয়। জুনের মধ্যে সংস্কারের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছানোর কথা জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, বৈঠকে সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, দেশের নাম পরিবর্তন, দ্বিকক্ষ সংসদসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে একেকটি প্রস্তাব প্রাথমিকভাবে একমত হলেও সেটি বাস্তবায়নের সময় ও বিধি-বিধান নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করে আগামী মাসের মাঝামাঝি দলগুলোর সঙ্গে ফের সংলাপে বসবে ঐকমত্য কমিশন।
এদিকে সংস্কার নিয়ে আলোচনায় ভিন্নমত প্রসঙ্গে জানা গেছে, এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর হতে পারবেন না বলে মত দিয়েছে এনসিপি। বিএনপি বলছে, এক ব্যক্তি টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তবে গ্যাপ দিয়ে তিনি আরও একবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রসঙ্গে বিএনপি বলছে, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যমান ক্ষমতা রেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। এদিকে এনসিপি বলছে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারবেন, তবে সব ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে না। দ্বিকক্ষ সংসদের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান- আনুপাতিক হারে ভোটগ্রহণ করতে হবে। বিএনপি দ্বিকক্ষ সংসদের বিষয়ে একমত হলেও আনুপাতিক ভোটে দ্বিমত।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়।
এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের ওপর স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। এখন পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কমিশন মতামত পেয়েছে। পরে সংস্কার কমিশনগুলোর করা সুপারিশ চূড়ান্ত করতে গত ২০ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এখন পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ ২০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রথম ধাপে বৈঠক করে বিস্তারিত আলোচনা চলছে।
ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেণ, আগামী দিনগুলোতেও এ আলোচনা অব্যাহত থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায় কমিশন, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পথরেখা তৈরি করবে।
সংস্কার প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, সব রাজনৈতিক দল তাদের প্রস্তাবগুলো জমা দিয়েছে অলরেডি (ইতোমধ্যে)। আমরা আমাদের সংস্কারের প্রস্তাব জমা দিয়েছি, অন্যান্য দলও দিয়েছে। এখন শুধু কোথায় কোথায় ঐকমত্য হয়েছে, সবাই তো এ ব্যাপারে একমত যে, ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কার হবে। সুতরাং যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, এই জিনিসগুলো বলা হচ্ছে না কেন। এটা তো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার না, এতে এক সপ্তাহও লাগার কথা না। কোথায় ঐকমত্য হচ্ছে, এই জিনিসটা বের করার জন্য তো নতুন কিছু আবিষ্কার করার দরকার নেই। শুধু একটা টেবিল (ছক) করা- যে এ জায়গায় ঐকমত্য হয়েছে। যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, সে বিষয়গুলোকে সামনে এনে ‘জাতীয় সনদ’ যেটা বলছে, সেটাতে সই করে দিলাম। সুতরাং নির্বাচন ঘোষণা তো আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে করা সম্ভব এবং ডিসেম্বরের অনেক আগে করা সম্ভব।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশনের সোমবার সন্ধ্যায় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। কমিশনের প্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৈঠকে সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেসব আলোচনা হয়েছে, সে ব্যাপারে কমিশন প্রধানকে অবহিত করেন। এ সময় পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
কমিশন সদস্য ছাড়াও বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান শুভ্র এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক ও সফর রাজ হোসেন অংশ নেন।