আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যরে পর নতুন পোপ নির্বাচনরে আলোচনা জোড়ালো হচ্ছে। ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যরে পর অন্তবর্তী দায়িত্বপালন করছেন কার্ডিনাল ফেরেল।
পোপের উত্তরসূরি হিসেবে নতুন পোপ নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কার্ডিনালরা রোমে সমবেত হচ্ছেন। তারাই নির্বাচন করবেন কে হচ্ছেন নতুন পোপ।

কার্ডিনাল (লাতিন ‘কার্ডিনালিস; শব্দ থেকে আগত) হলেন ক্যাথলিক গির্জার একজন উচ্চপদস্থ ধর্মগুরু, যিনি পোপের শাসনকার্যে তাকে সহায়তা করার জন্য মনোনীত হন। সরকারি মন্ত্রণালয়ের সমতুল্য হলি সি’র বিভিন্ন দপ্তরগুলো প্রধানত কার্ডিনালদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। তাদের পূর্ণ পদবি হলো ‘হলি রোমান চার্চের কার্ডিনাল’।
ডিনের নেতৃত্বে (বর্তমানে ৯১ বছর বয়সী ইতালীয় জিওভান্নি বাত্তিস্তা রে) কার্ডিনালরা একত্রে ক্যাথলিক গির্জার সর্বোচ্চ স্তর ‘কার্ডিনাল কলেজ’ গঠন করেন।
কার্ডিনাল একটি পদবি, কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব নয়- এই কারণে অনেক কার্ডিনাল বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ডায়োসিসের বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, আবার কেউ কেউ ভ্যাটিকানের প্রশাসনে (কিউরিয়া) অবস্থান করেন ও রোমেই বাস করেন।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভ্যাটিকানে রোমান ক্যাথলিক গির্জার নেতা নির্বাচনের কাজটি হয়ে আসছে। কার্ডিনালদের মধ্যে একান্তে অনুষ্ঠিত সভায় ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। এ বৈঠককে ঘিরে অনেক গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়।
রোমান ক্যাথলিকদের জন্য নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য ভোটাভুটির সময় হলে বিভিন্ন দেশের ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা রোমে যান। তাঁরা পৌঁছানোর পর সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা গির্জায় সকালবেলা বিশেষ একটি ধর্মীয় সমাবেশ হয়। বিকেলে ভোটাভুটিতে অংশ নিতে কার্ডিনালরা পায়ে হেঁটে সিস্টিন চ্যাপেলের দিকে যান, যা কনক্লেভ নাম পরিচিত।
এই কনক্লেভে রুদ্ধদ্বার সভায় ভোটাভুটি হয়। ভোটাভুটির ক্ষেত্রে কঠোরভাবে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। সিস্টিন চ্যাপেলে কোনো মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হয়েছে কি না, তা তল্লাশি করা হয়। কার্ডিনালদেরও বলে দেওয়া হয় যে, তাঁরা যেন এ ভোটপ্রক্রিয়া নিয়ে বাইরের কারও সঙ্গে আলাপ না করেন।
পোপ নির্বাচক: মোট কার্ডিনাল সংখ্যা ২৫২ জন। তবে কেবল ৮০ বছরের নিচের কার্ডিনালরাই ‘কার্ডিনাল ইলেক্টর’ হিসেবে নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারেন। বর্তমানে এ ধরনের ভোটার সংখ্যা ১৩৫ জন। পোপের মৃত্যু বা পদত্যাগের ক্ষেত্রে তারা নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য ভোট দিয়ে থাকেন।
কার্ডিনালরা নিযুক্ত হন না, বরং পোপের আদেশে তাদের ‘সৃষ্টি’ করা হয়। এই শব্দটির উৎপত্তি রোমান যুগ থেকে, যার মাধ্যমে বোঝানো হয়, ব্যক্তির গুণাবলির জন্য তাকে মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে, কিন্তু কোনো শূন্যপদ পূরণের জন্য নিযুক্ত করা হয়নি।
ভ্যাটিকান বিধি অনুযায়ী, পোপ কার্ডিনাল সৃষ্টি করতে পারেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে, যারা ‘বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান, নৈতিক গুণাবলি, ধর্মীয়তা এবং বাস্তবিক বুদ্ধিমত্তায় বিশেষভাবে বিশিষ্ট’।
কার্ডিনালরা গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরিধান করেন, যা একসময় রোমান সিনেটের প্রতীক ছিল- ক্ষমতা, মর্যাদা ও কর্তৃত্বের প্রতীক। এটি একইসঙ্গে খ্রিষ্টের রক্তের প্রতিনিধিত্বও করে। তারা একটি আংটি (প্রথাগতভাবে নীলকান্তমণির তৈরি), একটি বুকে ঝুলিয়ে পরার ক্রুশ, একখানা ঝুঁড়ি (ক্রোসিয়ার) এবং একটি মিত্র (বিশেষ টুপি) পরেন।

কার্ডিনাল সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে পোপ তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ করেন। এভাবে তিনি ভবিষ্যতে নিজের উত্তরসূরি নির্বাচনের সম্ভাব্য চেহারা গড়ে তোলেন। পোপ ফ্রান্সিস তার পন্টিফিকেটকালে বিশ্বের এমন অনেক ‘প্রান্তিক’ অঞ্চল থেকে কার্ডিনাল মনোনীত করেছেন, যেগুলো আগে রোমের দৃষ্টিতে প্রায় উপেক্ষিত ছিল।
কার্ডিনালরা ‘ইমিনেন্স’ উপাধি ধারণ করেন এবং গির্জার ক্রম অনুযায়ী পোপের পরই তাঁদের স্থান। তারা রোমের বাইরে সব গির্জায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারেন। এমনকি তাদের গির্জায় সমাহিতও করা যেতে পারে।
ভ্যাটিকান দ্বিতীয় পরিষদ কার্ডিনালদের অনেক বিশেষাধিকার কমিয়ে দেয়। আগে তারা ট্রেনে ভ্রমণের সময় পুরো একটি কামরা সংরক্ষণ করতেন এবং তাদের বাসভবনে একটি ‘সিংহাসন কক্ষ’ থাকত।
পোপ ফ্রান্সিস আরও একধাপ এগিয়ে ২০২৩ সালে সিদ্ধান্ত নেন, কার্ডিনালরা আর ভ্যাটিকানে ভাড়া ছাড়া অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবহার করতে পারবেন না। ২০২১ সালে তিনি ভ্যাটিকানের আর্থিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে কার্ডিনালদের বেতনও কমিয়েছিলেন, যা করোনাভাইরাস মহামারির ফলে হলি সী’রও পর সৃষ্ট ক্ষতি মোকাবিলায় সহায়ক হয়েছিল।