জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও সাবেক ৯ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগতা চেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনালে ২২ মামলায় ১৪১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আর শেখ হাসিনাসহ চারটি মামলার তদন্ত রয়েছে প্রায় শেষ পর্যায়ে।
আজ বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আয়োজিত এক মতবিনিময়সভায় এসব তথ্য তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখা। মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়াসহ বিস্তারিত তুলে ধরতে এ মতবিনিময়সভার আয়োজন করা হয়।
এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। সূচনা বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, ‘আমরা যদি জুলাই-আগস্টে এই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে না পারি তাহলে এরচে দুর্ভাগ্য এবং অযোগত্যা আর হতে পারে না।’
সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিচারের প্রক্রিয়া, সাক্ষ্য উপস্থাপন, তদন্ত নিয়ে আইনটি বিশ্লেষণ করেন প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার। এরপর প্রসিকিউটর তামিম সিয়েরালিওন, কম্বোডিয়া, চাদ, সেনেগালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া, তদন্ত ও রায়ের সময়সহ সাজার বিষয়টি উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সোবহান তরফদার, আব্দুল্লাহ আল নোমান প্রমুখ।
কাদের-কামালসহ ১০ জনের বিষয়ে রেড নোটিশের আবেদন
জুলাই-আগস্টে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও সাবেক ১০ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় এ তথ্য জানান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
আসামিরা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরাফাত, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
২২ মামলায় ১৪১ জনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা
মতবিনিময়সভায় জানানো হয়, জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় ৩৩৯টি অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের ওপর মামলা হয়েছে ২২টি। আর এসব মামলায় প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত ১৪১ জন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫৪ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৮৭ জন এখনো পলাতক। আর ১৪১ আসামির মধ্যে বেসামরিক ব্যাক্তি ৭০ জন, পুলিশ ও র্যাবের ৬২ জন এবং সামরিক বাহিনীর (বরখাস্ত ও অবসরপ্রাপ্ত) ৯ জন। এছাড়া ইতোমধ্যে ১ হাজার ব্যাক্তির জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
বিচার হবে ‘টপ কমান্ডার’ ও সরাসরি জড়িতদের
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে ‘টপ কমান্ডার’ ও যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের বিচার হবে। তিনি বলেন, টপ কমান্ডার যাদের কারণে রাষ্ট্রটা এমন হয়েছে তাদের আমরা ধরতে চাই। সাথে সাথে যারা সরাসরি জড়িত বলে আইডেন্টিফাই হয়েছে, সুপিরিয়র হুকুম দিয়েছে সত্য, তারপরেও গুলি করেছেন, তারপরে আহত ছেলের কাছে গিয়ে যখন গুলি করেছেন তখনতো কমান্ডের বাইরে গিয়ে এটা করেছেন। এই যে কাহিনীগুলো এবং লাশে আগুন দেওয়া এটা তো সুপিরিয়র কমান্ডার বলেনি, এটা সে আগের কমান্ডের অংশ হিসেবে মেরেছে, বাকিগুলো সে নিজেই করেছে। লাশে আগুন দিয়েছে, দাফন করতে দেয়নি। ফলে এই জাতীয় ঘটনায় যারা সরাসরি জড়িত তাদের ধরব আর প্রধানত যার কারণে অপরাধ হয়েছে যারা এটার ডিজাইন, প্ল্যান করেছে, নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিচার আগে হবে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সিয়েরালিওন, রুয়ান্ডা, আইসিসির (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) আদালতে ১০ জন ১২ জনের বিচার হয়েছে কেন? কারণ লাখ লাখ সোলজারের বিচার করা যায় না। সেকারণে সেখানে টপ কমান্ডারদের বিচার হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও আমাদের সেদিকেই যেতে হবে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যদি বিচার করি তাহলে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীও যেমন থাকবে না, আবার সঠিক মাত্রায় বিচার করলে বিভিন্ন বাহিনীতে সিনিয়ররা আছেন তারাও থাকবেন না। তাই আমরা চাই যাদের কারণে এটা হয়েছে যারা মাস্টারমাইন্ড যারা একেবারেই সরাসরি সম্পৃক্ত তাদেরই বিচারের আওতায় আনা হবে। তা না হলে এটা (বিচার) যদি অনন্তকাল ধরে চালানো হয় তাহলে রাষ্ট্রকেই ধরে রাখা যাবে না।’
য়গায় নিতে চাই। জাস্টিস প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। ভিকটিমদের বিচার পেতে সহযোগিতা করতে চাই।’
বোমা ছিল উত্তরায় গোপন বন্দিশালায়
সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অভিযোগ করেন, গুমের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে গোপন বন্দিশালায় বোমা রেখে তাদেরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। বুধবার (৯ এপ্রিল) ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘গত ২৫ জানুয়ারি আমরা একটা গোপন বন্দিশালা যেটা একটা বৃহত্তম গোপন কারাগার সেটা উত্তরাতে অবস্থিত। সেটাকে যখন আমরা আইডেন্টিফাই করি, এটা এত বড় সেন্টার ছিল যে পুরো জিনিসটা উদ্ধার করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা ভিকটিম গুম হয়ে বছরের পর বছর বন্দি ছিলেন আট বছর যারা ছিলেন তাকে যখন ৫ আগস্টের পরে মুক্ত করা হয়, তিনি অথবা বিভিন্ন সময়ে যত গুমের শিকার যারা বেরিয়ে এসেছেন আগে তাদের যে সমস্ত বক্তব্য তা আমাদের কাছেও আছে, গুম কমিশনের কাছেও আছে। তাদের বক্তব্য থেকে আমরা তাদের স্মৃতি থেকে একটা ম্যাপ আকি। সবাইকে হাত পা ও চোখ বেধে রাখত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাথরুমে গেলে খুলে দিত। এই যে প্রক্রিয়াটা এর মধ্যে যদি আট বছর থাকে তাহলে ভিকটিম কিছু না কিছু দেখে। তাকে খাবার চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এই যে আট বছরে প্রতিদিন যেসমস্ত ঘটনা ঘটেছে সেগুলো যখন স্মৃতি থেকে তিনি বলতে থাকেন তখন কল্পনায় একটা পিকচার আকতে পারে। সেরকমভাবে আমরা পিকচার একেছি। সে অনুযায়ী আমরা এটা (গোপন বন্দিশালা) আবিস্কার করলাম।’
বোমা উদ্ধারের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রুমটায় ঢোকার ঝুকি না নিয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করা হলো। ছিদ্র করার পর দেখা গেল ভেতরে দুইটা বড় বড় রুম আছে। সেই রুমগুলোতে লোহার রড, ইট জমা করে রাখা হযেছে। ওখানে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। দরজা কেটে ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকে বন্দির বর্ণনা অনুযায়ী ওই রুমের সাথে একটা বাথরুম ছিল। সেই বাথরুম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দেওয়াল স্ক্যান করা হলো। এককোনায় বাথরুমের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। সেই দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হযেছে। ওই সেলে তিনটি টর্চার রুম পাওয়া যায় যেখানে সাউন্ড প্রুফ করা। এর ভিতরে অজস্ত্র টর্চার মেটেরিয়াল আছে। রুমগুলো ভিতরে ময়লা আজর্জনা ছিল। ভাঙচোড়া চেয়ার ফার্নিচার কাপড় এগুলো রাখা হয়েছে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সেগুলো সরিয়ে প্রথম দুই দিন কিছু পাওয়া যায়নি। তৃতীয় দিন আবর্জনা সরিয়ে একটি নীল রঙের বালতি পাওয়া যায়। বালতির মধ্যে কিছু তুলা, গজ ব্যান্ডেজ, ধুলাবালি, নোংরা। বালতির জিনিস ঢালামাত্রই দেখা যায় যে, লাল টেপ মোড়ানো বড় বড় পাঁচটা বোমা বেরিয়ে এসেছে। সঙ্গে তার লাগানো টাইমার। সাথে সাথে এগুলো নড়াচড়া করতে নিষেধ করি। এখানে আরও কিছু ঘটনা আছে যেগুলো বলা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘২৬ জানুয়রি আমরা বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটকে খবর দিলাম। তারা ২৭ জানুয়ারি এসে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বোমাগুলো উদ্ধারের দিন বিস্ফোরণ হলে পুরো ভবনটি উড়ে যেত।’