প্রজ্ঞা দাস: বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দাবদাহ বা তীব্র তাপপ্রবাহ এখন বিশ্বব্যাপী একটি জ্বলন্ত সমস্যা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এর প্রভাবে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত কয়েক দশকে দেশে তাপমাত্রার রেকর্ড বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ এবং অসহনীয় গরম আবহাওয়া জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে শহরাঞ্চলে তাপদাহের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, যা স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় টেকসই সবুজায়ন এবং সবুজ সংস্কৃতি গড়ে তোলা হতে পারে একটি কার্যকরী সমাধান। সবুজায়ন শুধু গাছ লাগানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামগ্রিক জীবনধারার পরিবর্তন, যা পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে দাবদাহের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশে গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। এবারও গ্রীষ্মের শুরু থেকেই ঢাকার তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে, যা শহরের জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। দাবদাহের প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, যা মানবসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড় এবং শিল্পায়নের ফলে ত্বরান্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে গাছপালা ধ্বংস করা হয়েছে, যার ফলে প্রাকৃতিক ছায়া ও শীতলতা হ্রাস পেয়েছে। শহরগুলোতে কংক্রিটের অট্টালিকা এবং রাস্তাঘাট তাপ শোষণ করে পরিবেশের তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ প্রভাব নামে পরিচিত। উপরন্তু জ্বালানি খাতে অতিরিক্ত ফসিল জ্বালানির ব্যবহার এবং শিল্প বর্জ্য পরিবেশদূষণকে তীব্র করছে। ফলে দাবদাহের বহুমুখী প্রভাব বাড়ছে। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে এটি হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে। কৃষি খাতে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। পানীয় জলের সংকটও তীব্র হচ্ছে। এই তীব্র তাপদাহের কারণে সামগ্রিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ এবং গ্রামের কৃষকরা এই দাবদাহের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রকৃতি যেখানে আমাদের সহনশীলতার পরিধি, সেখানে আজ তা অব্যাহত নিপীড়নের শিকার। একদিকে বন ধ্বংস, অন্যদিকে অপরিকল্পিত কংক্রিটের নগরায়ণ; যেন মানুষ নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুর নকশা আঁকছে। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কখনো জেতা সম্ভব নয়। বরং প্রকৃতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের পথ চলতে হবে। টেকসই সবুজায়ন এই পথচলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল গাছ লাগানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে বন সংরক্ষণ, জলাশয় পুনরুদ্ধার, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, আর পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রা একত্রে কাজ করে।
গাছ আমাদের জন্য প্রাকৃতিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের মতো কাজ করে। এরা তাপ শোষণ করে, ছায়া দেয়, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে। শহরে সবুজ ছাদ আর উদ্যান তৈরি করতে হবে, এতে কংক্রিটের তাপ কমবে। পাশাপাশি গ্রামে বন সংরক্ষণে উদ্যোগী হতে হবে, যা পরিবেশ শীতল রাখবে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
শিক্ষার মাধ্যমে এই দায়িত্বশীলতার সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে হবে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে পরিবেশ সংরক্ষণের গল্প যুক্ত করা যেতে পারে, যাতে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা শেখে। যুবসমাজকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে উৎসাহিত করা যেতে পারে, যাতে তারা বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সচেতনতার প্রচারণায় অংশ নেয়। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালাতে হবে। কৃষকদের গাছ লাগাতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা বুঝতে পারেন যে সবুজায়ন তাদের জীবিকার জন্যও উপকারী। তবে বাংলাদেশে এই সবুজায়নের পথে কিছু বাধাও আছে। জনসংখ্যার চাপে জমির অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলছে। শহরে সবুজ জায়গা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা নেই, আর গ্রামে বন ধ্বংসের হার এখনও উদ্বেগজনক। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা আর স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে বন উজাড় রোধ করতে হবে। শহরে নতুন ভবন নির্মাণের সময় সবুজ ছাদ বা উল্লম্ব বাগানের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির মতো প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। এসব পদক্ষেপ শুধু দাবদাহ কমাবে না বরং আমাদের অর্থনীতিকে আরও টেকসই করে তুলবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে, কিন্তু উন্নয়ন যদি কংক্রিটে বন্দি হয়ে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, তাহলে সে উন্নয়ন নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী। সবুজ শুধু প্রাকৃতিক নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকার শর্ত। যে নগরে গাছ নেই, সে নগর প্রাণহীন। যে দেশে মানুষ গাছ কাটে, তারা নিজেদের ছায়া নিজের হাতে ধ্বংস করে। আজ যদি আমরা সবুজায়নের বিপ্লব শুরু না করি, তাহলে আগামীকাল শুধু গরম নয়, বাঁচার পরিবেশই থাকবে না। আমাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ জীবন দিতে পরিবেশকে কেন্দ্র করে নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অবতারণা করতে হবে; যেখানে শিশুরা প্রকৃতি ভালোবাসতে শিখবে, নাগরিকরা বৃক্ষরোপণ করে গর্ব অনুভব করে এবং রাষ্ট্র উন্নয়নের মাপকাঠিতে কংক্রিটের বদলে সবুজকে রাখে। তবেই জনজীবন রক্ষা পাবে, দেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
প্রজ্ঞা দাস : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ