পরশুরাম-ফুলগাজী (ফেনী): ফেনীর ইকরাম হোসেন কাউছার পড়তেন ঢাকার কবি নজরুল কলেজের মাস্টার্সে। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার। তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে পরিবারের হাল ধরবেন। এর মধ্যে শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। শুরু থেকেই তিনি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠার পর ১৯ জুলাই ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ একদিন। সেদিন পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কাউছার। থামে তার স্বপ্নযাত্রা। ছেলে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন তার মা রুমি আক্তার। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মানসিক ও শারীরিকভাবে। এখন ছেলের কথা শুনলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন।
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের রাজষপুর গ্রামের মাওলানা আনোয়ার হোসেন ও রুমি আক্তার দম্পতির সন্তান কাউছার। আনোয়ার হোসেন রাজষপুর বাজারের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব ও হাই স্কুলের শিক্ষক।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলা থেকে কাউছার মেধাবী, বিনয়ী ও ভদ্র হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। শালধর ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগে। ২০২৪ সালে শেষ হয় অনার্স। এরপর থেকেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের পাশে বন্ধুদের সঙ্গে একটি মেসে থাকতেন কাউছার। ১৯ জুলাই সকাল থেকে তাকে তার বাবা কল করছিলেন, কিন্তু মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছিল। বিকেলে একটি নম্বর থেকে কাউছার তার বাবাকে কল করে জানান, আজ বাসায় বুয়া আসেনি, তাই রান্না হয়নি। বাইরে একটি দোকানে চা-বিস্কুট খাচ্ছেন। এর আধাঘণ্টা পর আবারও ওই নম্বর থেকে কল আসে। কাউছারের বাবাকে বলা হয়, আপনার ছেলের মাথায় গুলি লেগে মারা গেছে।
সম্প্রতি কাউছারের বাড়িতে তার বাবা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। শহীদ কাউছারের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ফিসফিস করে বলেন, আস্তে কথা বলতে হবে। কাউছারের মা পাশের রুমে আছেন। পরিবারের চোখের মণি কাউছারের কথা শুনলেই কান্না শুরু করে। কাউছারকে হারানোর পর মানসিক ও শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার মা।
ছেলের লাশ শনাক্ত করার দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ১৯ জুলাই রাতে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে কাউছারের লাশ শনাক্ত করি। পোস্টমর্টেম শেষে কাউছারের মরদেহ বাড়িতে আনা হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কাউছারের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়, শটগান ইনজুরি ইন দ্য হেড। সেদিন পুরান ঢাকায় হেলিকপ্টারের উপর থেকে গুলি চালানো হয়েছিল। কাউছারের মাথার পেছনে গুলি লাগে। এতে মাথার খুলির পেছনের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কাউছারের বাবা বলেন, সে ছিল পরহেজগার। অনার্সে ভালো ফল করায় শুকরিয়া হিসেবে ১২টি নফল রোজা রেখেছিল। তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে গত কোরবানিতে।
যারা তার ছেলে হত্যায় জড়িত তাদের বিচার চান আনোয়ার হোসেন। সরকার শহীদ ও আহতদের পরিবারকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেগুলোর বাস্তবায়নের দাবি করেন তিনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিপ্লবের পর শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসন ও প্রতি পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দেওয়ার যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
কাউছারের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা আনোয়ার হোসেন। টিনশেডের একটি ছোট্ট ঘরে পরিবার নিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরটি। ৬ থেকে ৮ ফুট পানিতে কয়েকদিন ডুবেছিল। ভেঙে গেছে চারপাশের বেড়া। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছে শহীদ কাউছারের পরিবার।
এদিকে কাউছারের স্মৃতিকে ধরে রাখতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, শহীদ কাউছারের বাড়ির সড়কটি তার নামে নামকরণ, ধনীকুন্ডা হোসনে আরা উচ্চ বিদ্যালয়ে শহীদ কাউছার মেমোরিয়াল লাইব্রেরি করা হয়েছে। এ ছাড়া পরশুরামের একমাত্র অডিটোরিয়ামটি শহীদ কাউছারের নামে নামকরণে জেলা পরিষদে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।