‘আমার দিন-রাত, পৃথিবী, আমার জীবন- এর সবকিছুই ছিল রিয়া। সে এখন আর দুনিয়াতেই নেই। ফ্যাসিবাদের রোষানলের বুলেট আমার বুক থেকে ওকে কেড়ে নিল। আমার কোলের মধ্যে থাকাবস্থায় ওর ছোট্ট শরীরটাকে রক্তাক্ত হতে দেখেছি, আবার চিরদিনের জন্য তাকে হারিয়ে ফেলেছি।’
কথাগুলো বলছিলেন জুলাই বিপ্লবে প্রাণ দেওয়া রিয়া গোপের বাবা দীপক কুমার গোপ। রিয়ার জন্য এখনো ছটফট করেন বাবা দীপক। সন্তানহীন নিজেকে বর্তমান জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারছেন না তিনি। তার সবকিছুই এলোমেলো। রিয়ার মুখ ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা তার জীবনে নেই। আর মেয়ের প্রসঙ্গ উঠলে এখনো মাঝে মাঝে জ্ঞান হারান মা বিউটি গোপ।
দীপক কুমার গোপ স্থানীয় একটি রড-সিমেন্টের দোকানে ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করেন। বিউটি গোপ পেশায় গৃহিণী। বিয়ের পাঁচ বছর পর তাদের কোলজুড়ে এসেছিল রিয়া। খুবই হাসিখুশি ছিল। দুষ্টুমিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার আদুরে ছিল সে।
মাত্র সাড়ে ৬ বছর বয়স ছিল শিশু রিয়ার। বেঁচে থাকলে এ বছর সাতের কোটায় পা দিত। স্কুলে মাত্র যাওয়া-আসা শুরু করেছিল। নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় তাদের বাসস্থান। পাঁচতলা ভবনের ওপরের তলায় থাকত তারা।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। ঢাকাসহ সারা দেশ উত্তপ্ত। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে। এদিন সকাল থেকেই তাদের বাসার সামনের ডিআইটি নামক স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের বেশ কয়েকবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বাসার সবাই বেশ কিছুক্ষণ ছাদ থেকে সে সব দৃশ্যও দেখেন। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় সবাই ছাদ থেকে নেমে বাসায় চলে আসে। খাওয়া-দাওয়া শেষে আবারও বাড়ির অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ছাদে খেলতে যায় রিয়া।
দুপুর নাগাদ আবারও তাদের বাসার সামনের রাস্তায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এবার আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছোড়া হয়। অতিরিক্ত চিৎকার-চেঁচামেচি ও গুলির আওয়াজ শুনে বাবা দৌড়ে যান ছাদে মেয়েকে ঘরে আনতে। এরই মধ্যে লক্ষ্য করেন, রাস্তার আন্দোলনকারীদের দিকে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছোড়া হচ্ছে। মেয়েকে বাসায় আনতে কোলে নিলেন। ঠিক তখনই মেয়ের মাথায় একটা গুলি এসে লাগে। মুহূর্তেই বাবার কোলে ঢলে পড়ে রিয়া। আকস্মিক এই পরিস্থিতিতে স্তব্ধ হয়ে যান বাবা।
দিপক কুমার আমার দেশকে বলেন, ‘বাসার ছাদে নিজের কোলে মেয়ের গায়ে এসে গুলি লাগে। কিছু বলার থাকে? সেই পরিস্থিতি বুঝানোর ভাষা নেই। এখন আর নতুন করে স্মরণ করতে চাই না সেই সময়টা। একমাত্র মেয়ে আমার।’
দৌড়ে মেয়েকে নিয়ে বাবা ছোটেন বাসার সামনের জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করা হয় রক্ত বন্ধ করতে। এরই মধ্যে মেয়েটির অবস্থা শোচনীয় হতে থাকলে জেনারেল হাসপাতাল থেকে বলা হয় দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তখনো অনবরত তার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। বাবা মেয়েকে নিয়ে ছোটেন ঢামেকের উদ্দেশে। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, অপারেশন করতে হবে। মাথার গুলিটা বের না করলে অবস্থার আরো অবনতি হবে।
রিয়াকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। সে রাতেই মাথায় অপারেশন করা হলো। চিকিৎসকরা জানান, ৭২ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তারপর পরিস্থিতি বোঝা যাবে। এরই মধ্যে একদিন পার হয়। ২১ জুলাই সকালে রিয়াকে কিছুটা নড়াচড়া করতে দেখলে চিকিৎসকরা পরিবারকে আশ্বস্ত করেন, ‘পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে।’ পরিবারের সদস্যরাও আশা দেখেন। আরো দুদিন কেটে যায় আইসিইউতে। ২৪ তারিখ সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেয় ছোট্ট রিয়া।
দিপক কুমার গোপ বলেন, ‘আমার হারানো সন্তানের মুখ ছাড়া এখন আর আমি কিছু ভাবছি না। সরকার, বা কারো কাছ থেকে কিছু আশা করছি না। আমার এখন আর কথা বলতে ভালো লাগে না। ওর মা কীভাবে বেঁচে আছে জানি না। আমার কিছুই এখন আর ভালো লাগে না, আমার নিঃশ্বাসটাই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’