বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে তখন সব বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে যোগদান করে মাদরাসা শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম। খুলনার একটি মাদরাসার ছাত্র নাহিদ শিক্ষকদের বাধা উপেক্ষা করে নিয়মিত আন্দোলনে থাকায় তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন বড় ভাই মুফতি নাইমুল ইসলাম। কিন্তু ঢাকায় এনেও তাকে ঘরে রাখা যায়নি। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে রাজধানীর আদাবর থানা পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় সে। এরপর পুড়িয়ে ফেলার জন্য আগুনে ফেলা হয় নাহিদসহ চারজনের লাশ। তার সঙ্গে থাকা সহযোদ্ধা মেহেদি হাসান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
দুই মাসের ব্যবধানে ২০১৭ সালে বাবা মাওলানা আবদুল আজিজ ও মা নাছিমা আজিজকে হারায় নাহিদ। এরপর বেড়ে ওঠে বড় ভাই মাদরাসায়ে মাদীনাতুল উলুমের অধ্যক্ষ মুফতি নাইমুল ইসলামের কাছে থেকে। ছোট ভাইকে বিখ্যাত আলেম বানাতে খুলনায় মাদরাসাতুল কুরআন আল আরাবিয়ায় মাদানি নেসাবে ভর্তি করান। অপরদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করা নাহিদের বড় বোন সাদিয়া সুলতানা জোহানেসবার্গের দারুল উলুম জাকারিয়া মাদরাসায় পড়ানোর জন্য তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষকদের বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে যেত নাহিদ। বিষয়টি নাহিদের ভাই মুফতি নাইমকে জানিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন শিক্ষকরা। এরপর ৩ আগস্ট নাহিদকে ঢাকায় এনে মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকায় চাচার বাসায় রেখে আসেন মুফতি নাইম। একদিন চাচার বাসায় থাকলেও পরদিন দুপুরে হাসিনা পালিয়েছেন শুনে বিজয় মিছিলে যায় নাহিদ। আদাবর থানার সামনে পর্যন্ত গিয়েই বিক্ষুব্ধ জনতা থানার সামনে অবস্থান নেয়। সেখানে ছিল নাহিদও।
মেহেদী হাসান বলেন, কয়েকজন মিলে বাধা দিচ্ছিলাম, যেন কেউ থানার ভেতরে না যায়। তবে বিক্ষুব্ধ কয়েকজন বাধা উপেক্ষা করেই থানার গেটের কাছে গিয়ে ভেতরে ঢিল ছুড়ছিল। কয়েকজন থানার গেট খুলে ফেলে। তাদের সঙ্গে নাহিদও ছিল। সঙ্গে সঙ্গে গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর সবাই থানার সামনে থেকে সরে যেতে থাকে। এ সময় দেখি নাহিদের বুকে দুটি গুলি লেগে ফুটো হয়ে কলের পানির মতো রক্ত পড়ছে। এ সময় নাহিদ বলে ওঠে, ‘ভাই আমারে বাঁচান।’ এরপর নাহিদ কয়েক কদম হেঁটে থানার গেটের পাশে গিয়ে পড়ে যায়। তার সঙ্গে গুলিবিদ্ধ আরো কয়েকজন সেখানে পড়েছিল। এ সময় পুলিশ গুলি করতে করতে সামনে আসছিল। এ কারণে নাহিদদের রেখে সবাই থানার সামনে থেকে দূরে সরে যায়।
এরপর পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নির্বিচার গুলি চালিয়ে সেখানে অনেক মানুষকে হত্যা করে বলে জানান মেহেদী। তিনি বলেন, একপর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য থানার সামনে থাকা পুলিশের গাড়িগুলোয় আগুন দিয়ে নাহিদসহ গুলিবিদ্ধ চারজনের মৃত্যু নিশ্চিত করার পর তাদের লাশ আগুনে নিক্ষেপ করে। এ দৃশ্য দেখে আন্দোলনরতরা ইটপাটকেল ছুড়ে পুলিশকে পিছু হটতে বাধ্য করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেখানে পৌঁছানোর আগেই নাহিদের শরীরের একপাশ পুড়ে যায়।
মেহেদীরা সেখান থেকে নাহিদকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এরপর শহীদ নাহিদের লাশ নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার পরিবারকে খুঁজে না পেয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে লাশ রেখে আসেন তারা।
এদিকে বিকাল, সন্ধ্যা ও রাত পেরিয়ে গেলেও ভাইয়ের সন্ধান পাচ্ছিলেন না মুফতি নাইম। পরদিন ভাইয়ের শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে লাশ পান তিনি। এরপর হবিগঞ্জের লাখাই থানার মুড়িয়াউক গ্রামের নিজ বাড়িতে নেওয়া হয় নাহিদের লাশ। সেখানে বড় ভাই মুফতি নাইমুল ইসলামের ইমামতিতে জানাজার পর বাবা-মায়ের কবরের পাশে শহীদ নাহিদকে দাফন করা হয়।
মুফতি নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘আলেম এবং এ দেশের জনগণের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, তা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্যই আমাদের ভাইয়েরা শাহাদাতের মৃত্যু বেছে নিয়েছে। এত জীবনের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্তির পর এ ধরনের জুলুমের পুনরাবৃত্তি হোক, তা চাই না।’